Army Village in India: সাচ্চা দেশপ্রেমী, এই গ্রামে প্রতি বাড়ি থেকে একজন সেনায়, চিনে নিন ভারতের আর্মি গ্রামকে


গ্রামটা ছোটো। জনসংখ্যা মেরেকেটে ৭ হাজার। লড়াই ওদের রক্তে। আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে যুদ্ধজয়ের গন্ধ। এ গ্রাম দুটো মেলা দুষ্কর। এই গ্রাম আর পাঁচটা গ্রামের মতো না। এই গ্রামে ঢুকলে শোনা যায় দেশপ্রেম, আত্মত্যাগের গল্প। এটি পরিচিত আর্মি গ্রাম বা মিলিটারি গ্রাম নামে (Army Village in India)।

কোথায় অবস্থিত ভারতের আর্মি গ্রাম?

অন্ধ্রপ্রদেশের পশ্চিম গোদাবরী জেলায় একটি গ্রামের নাম মাধবরাম। সেনা গ্রাম (Army Village in India) নামেই বেশি পরিচিত। ৮-৮০ গল্প শোনায় আত্মত্যাগের, দেশাত্মবোধের। প্রত্যেকেরই লক্ষ্য সেনাবাহিনীতে যাওয়া। সুযোগ না পেলে? কুছ পরোয়া নেহি। পুলিশ তো আছেই। দেশের জন্য আত্মত্যাগটাই ওদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে।

ব্যবহার করা হয় শুধু সংষ্কৃত ভাষা, ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছে ভারতের এই গ্রাম

মাধবরাম গ্রামের লড়াইয়ের ইতিহাস

এই গ্রামের লড়াইয়ের ইতিহাস অনেক পুরোনো। ১৭-র দশকে ওডিশায় রাজত্ব ছিল গজপতি বংশের। রাজার ভাবনায় হঠাৎ করেই চলে আসে অন্ধ্রপ্রদেশের সুরক্ষা।

রাজা রাজ্যের সব প্রান্ত থেকে সিপাহীদের জড়ো করেন মাধবরাম গ্রামে। সেই শুরু। সময় গেছে, দিন বদলেছে, গ্রামের মানুষের মন থেকে লড়াই মুছে যায়নি।

বিশ্বযুদ্ধেও অবদান ছিল মাধবরাম গ্রামের

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অবদান ছিল এই গ্রামের। বহু মানুষ লড়েছিলেন। স্বাধীনতার পর একাধিক যুদ্ধেও এই সেনা গ্রামের অবদান অনস্বীকার্য।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে গ্রাম থেকে ৯০ জন সেনা যোগ দেন, এদের মধ্যে একজন শহিদ হন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রায় ১,১১০ জন সেনা অংশ নেন। ব্রিটিশদের হয়ে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তাঁরা।

তবে সবাই ফিরতে পারেননি। মোট ১১ জন শহিদ হন। সেই সময় মাধবরামের ‘শহীদ স্মৃতি’ তৈরী করা হয়।

মহাকাশ থেকে দেখা যায়, বাস্তবে যাওয়া যায় না, রাম সেতুর ইতিহাস কী?

দেশের যুদ্ধে মাধবরাম গ্রামের অবদান

১৯৬২, ১৯৬৫, ১৯৭১, ১৯৯৯ সালের যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন গ্রামের কোনও কোনও বীর সন্তান। কেউ শহিদ হয়েছেন। কেউ ফিরে এসেছেন। এসে শুনিয়েছেন যুদ্ধ জয়ের কাহিনী।

এদের জন্যই ২০১১ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের আদর্শ গ্রামের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে মাধবরাম।

‘ছেলের কিছু হলে সেটাই হত মাতৃভূমির প্রতি ওর ত্যাগ।’

আধুনিক যুগে পেশা

১০টা-৫টার চাকরি মাধবরামের কোনও প্রজন্মকেই টানে না। সরকারি বাবু হয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকায় ওরা নেই। ওরা চায় লড়তে। যুদ্ধজয় করতে। প্রাণ গেলে যাক। এখানে গ্রামের ঘরে শোপিজ়ের বদলে শোভা পায় মেডেল। বাড়ি বাড়ি বাজে দেশাত্মবোধক গান।

আড্ডায় উঠে আসে যুদ্ধের গল্প, শত্রুদের চোখে চোখ রেখে লড়াইয়ের গল্প। এখানে সবাই চায় সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে। তবে সবাই যে সফল হয় সেটা নয়। কেউ কেউ ব্যর্থও হয়।

কিন্তু তারাও কোনওভাবে জড়িত থাকে। স্থল, বায়ু, জল কোনও বাহিনীতে জায়গা না পেলে তারা চলে যায় পুলিশে। এই গ্রামের প্রতিটি বাড়ি থেকে অন্তত একজন সেনাবাহিনীতে রয়েছে। নাম ধরে ডাকা ওদের না পসন্দ। চায় পদ ধরে ডাকা হোক। সে সুবেদার হোক বা ক্যাপ্টেন।

এই গ্রাম থেকে প্রতি বছর গড়ে ৭৫ থেকে ৮০ জন যুবক ভারতের আর্মড ফোর্সে যোগ দেয়।

২০২২ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, মাধবরাম গ্রামের প্রায় ৩২০ জন বাসিন্দা এখন সেনায় চাকরি করছেন। ১,৮০০ জন অবসর নিয়ে বাড়িতে রয়েছেন।

গ্রামীণ সামাজিক প্রেক্ষাপটে সেনা (Indian Army)

  • গ্রামে প্রতিটি মানুষ মনে করেন সেনাবাহিনীর সদস্য হওয়া সম্মানের
  • এখানকার ছেলে বা মেয়েদের বিয়ে হয় সেনা বাহিনীর সদস্যের সঙ্গে
  • এই গ্রামে পোলেরাম্মা দেবীর একটি মূর্তি আছে। গ্রামবাসীদের বিশ্বাস এই দেবী সবাইকে নিরাপত্তা দেন

কীভাবে এত প্রজন্ম ধরে পেশা চলে আসছে?

এটা পারিবারিক শিক্ষা। এক প্রজন্ম তার পরের প্রজন্মকে সেনাবাহিনীতে (Indian Army) যাওয়ার জন্য তৈরি করে দেয়। সেই হিসেবে প্রশিক্ষণ, ফিটনেস, পড়াশোনা চলতে থাকে।

গ্রামের সেনা অ্যাসোসিয়েশন পরিকাঠামোর উদ্যোগ (Army Village in India)

  • ২০১৫ সালে গঠন করা হয় মাধবরাম এক্সসার্ভিসম্যান অ্যাসোসিয়েশন, যার সভাপতিত্ব করেন হোল্ডার সুন্দর রাও
  • এই সংস্থা গ্রাম উন্নয়ন, গ্রন্থাগার পুনরুদ্ধার, রানিং-ট্র্যাক, কমিউনিটি, জিমের তৈরি ও সেটা রক্ষণাবেক্ষণ করে

সবার মুখে দেশের কথা, সেনার কথা

  • মাধবরামের বাসিন্দা সুবেদার ভেমপাল্লি ভেঙ্কটাচালাম। তিনি বিভিন্ন সময়ে রায় বাহাদুর, পাল্লাকি সুবেদার, ঘোদা সুবেদার ও ভিক্টোরিয়া ক্রস মেডেল (ব্রিটিশ শাসিত ভারতে সাহসিকতার জন্য সর্বোচ্চ পুরস্কার)-এ পেয়েছেন
  • তাঁর পরিবারও সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত। ছেলে মারকানডেউলু ১৯৬২ সালের ভারত-চিন যুদ্ধ, ১৯৬৫ সালের ভারত-পাক যুদ্ধ ও ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন
  • সুবেদার ভেমপাল্লির নাতি সুব্বারাও নায়ডু ভারতীয় সেনার হাবিলদার পদ থেকে অবসর নিয়েছেন। সুব্বারাওয়ের ছেলে বর্তমানে ভারতীয় সেনায় (Indian Army) কর্মরত। ওদের মূল মন্ত্র একটাই, ‘লড়ে যাও। দেশের জন্য লড়ে যাও’

লড়াইয়ের কাহিনীই শোনাচ্ছিলেন বিজয় মোহনের বাবা। ছেলে জওয়ান। উরি থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে পোস্টিং ছিল তাঁর। ২০১৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর উরি সেনা ছাউনিতে হামলা চালায় জঙ্গিরা। শহিদ হন ১৮ জন জওয়ান। তবে, বেঁচে যান বিজয়।

তাঁর বাবা বলছেন, ‘ছেলের কিছু হলে সেটাই হত মাতৃভূমির প্রতি ওর ত্যাগ।’ তাল মিলিয়ে বিজয়ের মা বললেন, ‘ওই সময় একবার কথা হয়েছিল ছেলের সঙ্গে। বলেছিলাম, তুমি যুদ্ধক্ষেত্রে আছ। গর্বিত হওয়া উচিত। আরও সাহসী হও।’

বিজয়ের মতো একাধিক জওয়ানের মা আশায় বুক বাঁধেন, ‘ছেলে দেশের হয়ে লড়বে।’ আশায় বুক বাঁধছেন কাভুলরি পরিমালাও।
তাঁর অবশ্য ছেলে নেই। আছে মেয়ে। তাঁর কথায়, ‘যুদ্ধে আমার স্বামীকে হারিয়েছি। তাতে দুঃখ নেই। এবার মেয়েকে সেনায় পাঠাতে চাই। যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে ও শহিদ হলে ভাবব দেশের জন্য আত্মত্যাগ করেছে।’

বর্তমান সময়, চ্যালেঞ্জ ও পরিবর্তন

  • অগ্নিপথ স্কিম নিয়ে গ্রামে শঙ্কা: নির্ধারিত ৪ বছরের পরিষেবা অনেক যুবকের কাছে হতাশার
  • গ্রামে অনেক পরিকল্পিত প্রকল্পের কাজ হচ্ছে ন। এতে হতাশা আসছে গ্রামবাসীদের মনে
  • রেল যোগাযোগ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রত্যাশামতো উন্নয়ন হয়নি

প্রতিদিন বিকেল হতেই গ্রামের প্রত্যেকে ছোটেন শহিদ সৌধের দিকে। গ্রামের মাঝে তৈরি করা হয়েছে এই সৌধ।

যেখানে শহিদ জওয়ানদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা হয়। গ্রামের প্রবেশ পথে রয়েছে পোলেরাম্মা মন্দির। এখানে পুজো দেন মাধবরামের বাসিন্দারাই।

গ্রামবাসীরা বললেন, ‘আমরা মনে করি, এই মন্দিরে পুজো দিলে দেবতা যুদ্ধক্ষেত্রে রক্ষা করবেন।’ গ্রামে প্রাক্তন সেনাদের (Indian Army) নিয়ে তৈরি হয়েছে সংগঠন। যার সদস্য সংখ্যা ১১৮০ জন। সেখানেই চলে কিশোরদের প্রশিক্ষণ।

বিকেলের দিকে লাঠি খেলায় মত্ত ছিল বছর আটের হিমাংশু। কথায় কথায় বলল, ‘বাবাই আমার অনুপ্রেরণা। উনি দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন। আমিও লড়তে চাই। প্রাণ গেলে যাক।’

তথ্যসূত্র

Deccan Chronicle
The Better India
The Hindu
Wikipedia
Deccan Chronicle
The Caravan
The New Indian Express



Discover more from Unknown Story

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Exit mobile version