ভালোবাসার জন্য ভেঙেছিলেন আস্ত পাহাড়, জেনে নিন মাউন্টেন ম্যান দশরথ মানঝির গল্প

দশরথ মানঝি The mountain man

কেউ কথা রাখেনি কবিতায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন ‘ভালোবাসার জন্য আমি হাতের মুঠোয়ে প্রাণ নিয়েছি, দূরন্ত ষাঁড়ের চোখে বেঁধেছি লাল কাপড়…’।

নিজের পছন্দের মানুষটার জন্য হাতের মুঠোয় প্রাণ নেওয়া বা পরিবারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে লড়াই করার উদাহরণ ভুরি ভুরি আছে। আপনি বা আপনার চেনাজানা কেউ নিশ্চই করেছেন। কিন্তু ভালোবাসার জন্য পাহাড় ভাঙতে পারবেন? বা আপনার পরিচিত মানুষ কেউ করেছেন?

চলুন, আজ এমন একজনের কাহিনী বলি, যিনি ভালোবাসার জন্য আস্ত পাহাড় ভেঙে তৈরি করেছেন রাস্তা। ঠিকই শুনেছেন, পাহাড় ভেঙে রাস্তা। তাও একা এবং হাতুড়ি, ছেনি দিয়ে। তিনি দশরথ মানঝি। যিনি পরিচিত দ্য মাউন্টের ম্যান নামে। চিনে নিন তাঁকে-

কে ছিলেন দশরথ মানঝি?

বিহারের গয়া জেলার গেহলৌর গ্রামের একজন সাধারণ মানুষ ছিলেন দশরথ মানঝি। দিন আনি দিন খাওয়া জীবন ছিল তাঁর।

নামের পাশে ছিল দলিত তকমা। তবে আর্থিক, সামাজিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকলেও তাঁর জীবনে প্রেম ছিল।

জন্ম ও শৈশব

দশরথ মানঝি ১৯৩৪ সালে গেহলৌর গ্রামের একটি নিম্নবর্ণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। গ্রামে তখন ছোঁয়াছুঁয়ি প্রথা, বর্ণবাদ এবং আর্থিক বৈষম্য ছিল।

নিচু জাতির জন্য শিক্ষার কোনও সুযোগ ছিল না। তাই সংসারের হাল ধরতে তাঁকে শিশু শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে হতো। জীবনের প্রথম থেকেই তাঁকে দু’মুঠো ভাতের জন্য খাটতে হয়েছে দিনের পর দিন।

Dashrath Manjhi

সংসার ও স্ত্রী ফাগুনি দেবী

এই কষ্টের মধ্যেই দশরথ মানঝির জীবনের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা ছিলেন তাঁর স্ত্রী ফাগুনি দেবী।

সেই সময়ে কিশোর বয়সে বিয়ের রীতি ছিল, সে হয় দশরথ মানঝির ক্ষেত্রেও। দারিদ্রতা ও সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে তাঁরা তৈরি করেছিলেন প্রেমের এক সংসার।

কেন পাহাড় ভাঙার সিদ্ধান্ত নেন দশরথ মানঝি?

এরজন্য ভৌগলিক সীমানাও কিছুটা দায়ি। দশরথ মানঝির গ্রাম গেহলৌরের চারপাশে ছিল পাহাড়।

গ্রাম থেকে নিকটবর্তী শহর বা হাসপাতাল যেতে হলে পাহাড়ের চক্কর কেটে প্রায় ৫৫ কিলোমিটার রাস্তা ঘুরে যেতে হতো।

অর্থাৎ, পাহাড় টপকে গেলে যেটা ২০ কিলোমিটার হতো, সেটা ঘুরপথে যেতে হতো ৫৫ কিলোমিটার।

ফলে গ্রামে একাধিকবার দেখা গিয়েছে অনেকে মারা গিয়েছেন বিনা চিকিৎসায়। শহরে যাওয়ার জন্য একটা বা দুটো বাস থাকত।

এই কঠিন অবস্থার মধ্যে একদিন দুর্ঘটনা ঘটে। ফাগুনি দেবী গর্ভাবস্থায় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন।

দশরথ তাঁকে হাসপাতালে সময়ে নিয়ে যেতে পারেননি। পাহাড় পেরিয়ে যেতে দেরি হয়ে যায়।

সময়ে চিকিৎসা শুরু না করায় ফাগুনি দেবী মারা যান। এটাই দশরথ মানঝির জীবনে আনে পরিবর্তন।

যাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন তাঁকে হারিয়ে দশরথ সিদ্ধান্ত নেন সেই পাহাড় সরিয়ে দেওয়ার।

Dashrath Manjhi

পাহাড় ভাঙার শুরু

১৯৬০ সালে দশরথ মানঝি হাতে শাবল, হাতুড়ি আর ছেনি নিয়ে একাই পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি করতে শুরু করেন।

গ্রামের মানুষ প্রথমে তাঁকে পাগল বলত, হাসাহাসি করত। যেটা আমি বা আপনি হলে সেটাই করতাম।

কিন্তু মানঝির মনোবল ভাঙেনি। প্রতিদিন ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খেটে যেতেন। রোদ, ঝড়, জল, বৃষ্টি কিছুই তাঁকে রুখতে পারেনি।

ব্যবহার করা হয় শুধু সংষ্কৃত ভাষা, ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছে ভারতের এই গ্রাম

কীভাবে সম্ভব হল একাই পাহাড় ভাঙা

দশরথ মানঝি পাহাড় ভাঙার পাশাপাশি দিনমজুরির কাজও করতেন। সেই টাকার একটা অংশ খরচ করতেন খাবারের পিছনে আর বাকিটা দিয়ে কিনতেন পাহাড় ভাঙার শক্তিশালী ছেনি, হাতুড়ি, শাবল।

এই পাহাড় ভাঙতে লেগে যায় ২২ বছর। নিরন্তর পরিশ্রম করে তিনি পাহাড় কাটেন। সরকার বা জনপ্রতিনিধি কেউ এগিয়ে যাননি বলে অভিযোগ।

কত বড় রাস্তা তৈরি করেন দশরথ মানঝি?

প্রায় ৩৬০ ফুট লম্বা, ৩০ ফুট চওড়া এবং ২৫ ফুট উঁচু পাহাড় কেটে তিনি একাই রাস্তা তৈরি করেন।

এর ফলে আগের ৫৫ কিমি রাস্তা কমে দাঁড়ায় মাত্র ১৫ কিমি। গেহলৌর গ্রামের মানুষ সহজেই নিকটবর্তী শহর, স্কুল, হাসপাতাল ও বাজারে যেতে সক্ষম হয়।

দশরথ মানঝির আর্থিক অবস্থা কখনই ভালো ছিল না। পাহাড় ভাঙার সময় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তিনি ক্ষুধার্ত থাকতেন।

পাথর বিক্রি করে সামান্য আয় হত, কিন্তু তা খুবই নগণ্য। একসময় বাড়িঘর বিক্রি করতেও বাধ্য হন।

কখনও কখনও ভিক্ষাও করতে হয়েছে, যাতে তাঁর কাজের ধারাবাহিকতা বজায় থাকে।

‘Manjhi the Mountain Man’ সিনেমায় খুব সুন্দরভাবে দেখানো হয়েছে কীভাবে তিনি দিনের পর দিন এক বেলায় খাবার খেয়ে জীবন চালাতেন আর পাহাড় কাটার সরঞ্জাম কিনতেন।

মন ছুঁয়ে যাওয়া ঘটনা, ভারতের এই গ্রামের সকলেই করেছেন চক্ষুদানের অঙ্গীকার

গ্রামের মানুষের মানসিকতা বদল

যারা প্রথমে তাঁকে পাগল বলত, হাসাহাসি করত, তারা একসময় তাঁর কাজে হাত লাগায়।

গ্রামের যুবকরাও অনুপ্রাণিত হয়। দশরথ মানঝি তখন আর একা ছিলেন না। তাঁর অদম্য ইচ্ছাশক্তি একসময় সমাজকে নাড়া দেয়।

স্থানীয় পঞ্চায়েত ও সংবাদমাধ্যম তাঁর কীর্তি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে দেয়।

দশরথ মানঝির মৃত্যু

দীর্ঘ সংগ্রামের পর ২০০৭ সালের ১৭ অগস্ট, দশরথ মানঝি ৭৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।

শেষ জীবনে তাঁর অবদান সরকারি মহলে স্বীকৃতি পেতে শুরু করে। বিহার সরকার তাঁর শেষকৃত্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সম্পন্ন করে, যা তাঁর মতো একজন সাধারণ মানুষ ও দলিত সম্প্রদায়ের জন্য বিরল সম্মানের বিষয়।

পাহাড় ভাঙার সময়ে তিনি যদি সরকারি সাহায্য পেতেন, তা হলে হয়তো আরও ভালো জীবন কাটাতে পারতেন।

নদীর উপরে আস্ত রেল স্টেশন, ভারতেই রয়েছে এই বিষ্ময়, জানুন কোথায়

তাঁর কাজের সরকারি স্বীকৃতি

পাহাড় ভাঙার প্রায় দুই দশক পর বিহার সরকার তাঁর রাস্তা পাকা করে দেয়। পরবর্তীতে তঁর নামে রাস্তার নামকরণ হয় — ‘Dashrath Manjhi Road’।

আজও গেহলৌর গ্রামে গেলে দেখা যায় সেই রাস্তা, যে রাস্তা একজন মানুষের শ্রম ও ভালোবাসা দিয়ে তৈরি হয়েছে। পর্যটকরাও সেখানে যান তাঁর স্মৃতিস্তম্ভ দেখতে।

কেন দশরথ মানঝির গল্প অনুপ্রেরণার

তাঁর জীবনকাহিনি ভারতের গরিব মানুষের প্রতীক। তাঁর মতো একজন দিনমজুর পাহাড় ভেঙে নতুন রাস্তা তৈরি করেছেন — এমন নজির বিরল।

শুধু রাস্তা নয়, তিনি একটি নতুন ভাবনার রাস্তা খুলে দিয়েছেন — ‘‘অসম্ভব বলে কিছু নেই, যদি মন থেকে চেষ্টা করা যায়।’’

বর্তমানে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি কোটি টাকা খরচ করে যেই রাস্তা বা ব্রিজ তৈরি হচ্ছে সেটা লম্বা সময় ধরে চলে না। সেই পরিস্থিতি দশরথ মানঝি রোড তাদের গালে একটা থাপ্পড়।

দশরথ মানঝি প্রমাণ করেছেন, কাজ করতে গেলে পুঁথিগত বিদ্য়া থাকলেই হয় না। দরকার ইচ্ছা ও করে দেখানোর খিদে।

দশরথ মানঝির পরিবার এখন কোথায়

তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পরিবার গেহলৌর গ্রামেই আছে। সরকারের পক্ষ থেকে কিছু আর্থিক সাহায্য ও বাড়ি দেওয়া হয়েছে।

ছেলে, নাতি-নাতনিরা ছোট চাকরি ও কৃষিকাজ করছে। পর্যটকরা গেলে তাঁদের থেকে সেই ইতিহাস শোনেন।

তথ্যসূূত্র:

Manjhi Moves a Mountain — Nancy Churnin & Danny Popovici
সিনেমা: Manjhi – The Mountain Man (2015)
BBC Documentary on Dashrath Manjhi
Bihar Tourism Official Website
The Better India – Dashrath Manjhi Article
Scroll.in – Life of the Mountain Man



Discover more from Unknown Story

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Leave a Reply