আপনি যদি ক্রিকেট ভক্ত হন বা ক্রিকেট খেলে থাকেন তা হলে আপনার আগ্রহে লর্ডস থাকবেই। ইংল্য়ান্ডের লন্ডনে ক্রিকেটের মক্কা লর্ডসে অন্তত জীবনে একবার হলেও খেলতে চান প্লেয়াররা। সেখানে বড় রান বা উইকেট নিতে পারলে তো কথাই নেই। ক্রিকেটের মক্কায় যেমন রয়েছে একাধিক রেকর্ড, তেমনই লর্ডসে রয়েছে এমন এক ঢাল যা আলোচনায় এবং যেটা একটা বড় রহস্য।
লর্ডস বাকি স্টেডিয়ামগুলোর থেকে আলাদা। এর কারণ হচ্ছে লর্ডসের স্লোপ বা ঢাল।
লর্ডস স্টেডিয়ামে রয়েছে রয়েছে একটা ঢাল, যেটা কিছু প্লেয়ারের কাছে চ্যালেঞ্জের, আবার কিছু প্লেয়ারের কাছে সুবিধার।
জেনে নিন লর্ডসের বিখ্যাত স্লোপের ব্যাপারে।
লর্ডসের ইতিহাস
লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ডের শুরু ১৭৮৭ সালে। থমাস লর্ড নামের এক ব্যক্তি মেরিলেবোন ক্রিকেট ক্লাব (MCC)-এর জন্য প্রথম মাঠ তৈরি করেন।
এটি প্রথমে ছিল ইংল্যান্ডের হ্যাম্পস্টেড এলাকায়। এরপর তিনবার এই মাঠটি স্থানান্তরিত করা হয়।
১৮১৪ সালে বর্তমান লর্ডস মাঠের অবস্থান নির্ধারিত হয় এবং সেখানেই আজকের মাঠটি বিশ্ব ক্রিকেটের মূল কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত।
লর্ডসের স্লোপ
লর্ডস স্টেডিয়ামের একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে স্লোপ। স্লোপটি মূলত স্টেডিয়ামের উত্তর পশ্চিম দিক থেকে দক্ষিণ পূর্ব দিকে নেমে গেছে। এর ফলে মাঠের এক প্রান্ত অন্য প্রান্তের থেকে প্রায় আড়াই মিটার নিচু।
অর্থাৎ, মাঠের উত্তর পশ্চিম কোণ দক্ষিণ পূর্ব কোণের থেকে উঁচুতে অবস্থিত।
আরও ভালো করে বলতে গেলে, মাঠের দুটো প্রান্ত প্যাভিলিয়ন এন্ড এবং নার্সারি এন্ডের উচ্চতার পার্থক্য রয়েছে। বোলার যখন বল করেন, তখন এই স্লোপের কারণে তা দিক পরিবর্তন করে।
এই স্লোপ এখনও কেন রয়েছে?
লর্ডসের স্টেডিয়াম যে দিন তৈরি হয়েছিল সেই সময়ে ইঞ্জিনিয়ারিং বর্তমানের মতো এত উঁচু মানের ছিল না।
থমাস লর্ড যখন এই স্থান নির্বাচন করেন, তখন এই জমিটা ছিল উঁচু-নিচু।
সমতল করার চেষ্টা হলেও পুরোপুরি সমান করা সম্ভব হয়নি। কিছুটা ঢাল রাখা হয়েছিল যাতে বৃষ্টির জল দ্রুত বেরিয়ে যেতে পারে।
অনেকে বলেন, এই স্লোপ জল নিকাশির কাজ করে থাকে। কারণ লন্ডনে বৃষ্টি যখন তখন হয়, সেই কারণে এখানে জল নিকাশিটা চ্য়ালেঞ্জের। সেই চ্যালেঞ্জ কমাতেই মাঠে ঢাল রাখা হয়।
লর্ডসের স্লোপের ইতিহাস
লর্ডসের স্লোপ নিয়ে বহু কিংবদন্তি খেলোয়াড় তাঁদের স্মৃতিচারণা করেছেন। উইজ়ডেন ক্রিকেট আর্কাইভ, MCC-র আর্কাইভ এবং বহু প্রাক্তন ক্রিকেটার তাদের স্মৃতিতে লর্ডসের স্লোপকে বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন।
১৯৫২ সালে পাকিস্তান টেস্ট দলের ফজ়ল মাহমুদ এই স্লোপকে কাজে লাগিয়ে ইংল্যান্ডের ব্যাটিংকে গুঁড়িয়ে দেন।
কার্টলি অ্যামব্রোজ, গ্লেন ম্যাকগ্রা, ওয়াসিম আক্র, জেমস অ্যান্ডারসন, জশপ্রীত বুমরার মতো প্লেয়াররা এই স্লোপকে কাজে লাগিয়ে বাজিমাত করেছেন।
চলছে ২২৫ বছর ধরে, কেন উইম্বলডনে সাদা পোশাক পরেন খেলোয়াড়রা?
স্লোপ কী ভাবে বোলারদের খেলায় প্রভাব ফেলে?
বোলারদের জন্য লর্ডসের স্লোপ এক প্রকার স্বপ্ন। স্যুইং বা সিম বোলাররা এই স্লোপ ব্যবহার করে বলকে অতিরিক্ত মুভ করাতে পারেন।
বিশেষ করে যারা প্যাভিলিয়ন এন্ড থেকে বোলিং করেন, তাদের ইনসুইং বা আউটসুইং প্রায়ই ব্যাটসম্যানকে বিভ্রান্ত করে।
যেমন, ডান হাতি পেসার যদি প্যাভিলিয়ন এন্ড থেকে বল করেন, তা হলে অফ স্টাম্পের বল ভিতরের দিকে আসতে পারে।
এতে বল প্রত্যাশার থেকে বেশি টার্ন নেয়। বাঁহাতি পেসারদের ক্ষেত্রে ঠিক উল্টোটা হয়।
ব্যাটারদের জন্য স্লোপের সুবিধা ও অসুবিধা
স্লোপ নিয়ে ব্যাটারদের মিশ্র অভিজ্ঞতা রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, এটি ব্যাটারদের জন্য কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করে। আবার অনেকে বলেন, একবার লাইন বুঝে গেলে ব্যাটারদের সমস্য়া হয় না।
তবে এই স্লোপকে কাজে লাগাতে না পারলে ব্যাটার বা বোলার দুই পক্ষেরই সমস্যা।
সাদা থেকে রংচংয়ে জার্সি, সময়ের সঙ্গে কীভাবে বদলে যাচ্ছে ক্রিকেট
সুবিধা
- একপ্রান্ত থেকে খেলে গেলে বোলারের বলের মুভমেন্ট বেশি হয়। এতে উইকেট পেতে সুবিধা হয়
- স্লোপের কারণে আউটফিল্ডে বল দ্রুত যায়
অসুবিধা
- নতুন ব্যাটাররা প্রথমে লাইন ও লেংথ বুঝতে সময় নেন
- সিম মুভমেন্ট অনেক বেশি হয়
- অতিরিক্ত স্যুইংয়ের কারণে কভার ড্রাইভ বা কাট শট ঝুঁকির হয়
ফিল্ডিংয়ে স্লোপের ভূমিকা
শুধু ব্যাটিং বা বোলিং নয়, ফিল্ডিংয়ের উপরেও স্লোপের প্রভাব থাকে। ডিপ স্কয়্যার বা থার্ড ম্যানে বল গেলে স্লোপের কারণে বলের গতি বেড়ে যায়।
ড্রেনেজ সিস্টেমের জন্য স্লোপ কতটা গুরুত্বপূর্ণ
আধুনিক জল নিকাশি ব্যবস্থা থাকলেও লর্ডসের ঐতিহাসিক স্লোপ এখনও জল বের করতে সাহায্য করে।
প্রায় সারা বছরই লন্ডনে বৃষ্টি হয়। ফলে মাঠ সমতল হলে জল জমে খেলা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। স্লোপের কারণে সেই সমস্যা অনেকাংশে এড়ানো যায়।
দাবাকে দাবায়ে রাখতে পারবা না, দাবাকে জানতে হবে
লর্ডসের ঐতিহাসিক স্টেডিয়ামে স্লোপ থাকা উচিত কি না
- সময়ের সঙ্গে অনেকে বলেছেন যে লর্ডসের মাঠকে পুরোপুরি সমান করা উচিত। আধুনিক স্টেডিয়ামগুলোতে এমন ঢাল থাকে না। এতে সবাই সমান সুবিধা পায়।
- ২০০২ সালে লর্ডস নতুনভাবে তৈরির সময়ে স্লোপ নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। তবে ঐতিহ্য নষ্ট হবে এই ভেবে স্লোপ রেখে দেওয়া হয়।
ক্রিকেট ঐতিহ্য সংরক্ষণের দিক থেকে MCC এবং ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ড এখনো মনে করে, এই স্লোপ লর্ডসের প্রাণ।
মাঠের কোন কোন প্রান্তে স্লোপ বেশি?
প্যাভিলিয়ন এন্ড থেকে নার্সারি এন্ড পর্যন্ত মাঠের সবচেয়ে বড় ঢাল দেখা যায়। সাধারণত স্লিপ কর্ড আর গালির ফিল্ডাররা বলের দিক বুঝতে বিশেষভাবে সচেতন থাকেন।
অনেক অভিজ্ঞ ফিল্ডার বলেন, লর্ডসের স্লোপ বুঝতে ১-২ ম্যাচ লাগে।
ভবিষ্যতে কি স্লোপ থাকবে?
২০২৫ সালের আপডেট অনুযায়ী, লর্ডসের স্ট্রাকচারাল পরিকল্পনায় এখনো স্লোপ রয়ে যাবে বলে MCC জানিয়েছে। দর্শকরা এটিকে লর্ডসের DNA হিসেবে বিবেচনা করেন।
ক্রিকেটারদের স্মৃতিতে লর্ডসের স্লোপ
অনেক কিংবদন্তি ক্রিকেটারের মতে, লর্ডসের স্লোপ তাদের বোলিং ক্যারিয়ারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। জেমস অ্যান্ডারসনের স্যুইং মাস্টারক্লাস, ম্যাকগ্রার সিম বোলিং বা ওয়াসিম আক্রমের রিভার্স স্যুইং শক্তিশালী হয়েছে লর্ডসের এই স্লোপের কারণে।
লর্ডসের স্লোপ: ক্রিকেটের ঐতিহ্য
সব বিতর্কের মাঝেও বলা যায়, লর্ডসের স্লোপ ক্রিকেটের এক অমূল্য ঐতিহ্য। এটি না থাকলে লর্ডস শুধু আর পাঁচটার ক্রিকেট মাঠের মতো থাকত।
মাঠের এই প্রাকৃতিক ঢাল খেলোয়াড়দের মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা পরীক্ষা করে। এটাই লর্ডসকে ক্রিকেট মাঠের লর্ড বানায়।
লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ডের স্লোপ হলো সেই ছোট্ট ঢাল যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ক্রিকেটকে রোমাঞ্চিত করে রেখেছে। প্রতিটি ম্যাচে নতুন নতুন গল্প তৈরি হচ্ছে এই স্লোপকে কেন্দ্র করে।
তথ্যসূত্র
Marylebone Cricket Club (MCC) Archives
Wisden Cricketers’ Almanack
ESPN Cricinfo Ground Reports
The Guardian Sports
BBC Sport Cricket
এই ধরনের কনটেন্ট পেতে আমাদের পাশে থাকুন। ফলো করুন আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ায়
Discover more from Unknown Story
Subscribe to get the latest posts sent to your email.
Leave a Reply