গোওওওওওওওলললল!!!!! আপনি যদি বাঙালি হন, তাহলে গোল বলে এভাবে চিৎকারটা একবার হলেও করেছেন। সেটা বিদেশি ফুটবল দেখে হোক বা ভারতীয় ফুটবল। হতে পারে আপনি ফুটবলের অন্ধ ভক্ত নন, কিন্তু যাওয়ার পথে কোথাও ফুটবল খেলা হলে অন্তত ১ মিনিট দাঁড়িয়ে সেটা দেখেন বা রিলস স্ক্রোল করতে করতে ফুটবলের কোনও ক্লিপ আসলে সেটাও দেখেন। আসলে বাঙালিদের রক্তে ফুটবল, কারও সেটার মাত্রা বেশি আবার কারও কম। আর এই কাজটা করতে যিনি অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন তিনি নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী (Nagendra Prasad Sarbadhikari)। বাংলার প্রথম ফুটবলার। বাংলার যুবক যিনি ব্রিটিশদের পা থেকে বল কেড়ে বাঙালিকে ফুটবল খেলা শিখিয়েছিলেন। unknownstory.in -এর এই প্রতিবেদনে জেনে নিন সেই গল্প-
Table of Contents
বাংলার প্রথম ফুটবলার: ইতিহাসের অজানা অধ্যায়
ফুটবল মানেই বাঙালির আবেগ। কলকাতা ময়দান ছাড়া বাঙালি সমাজকে কল্পনাই করা যায় না। মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল থেকে শুরু করে পাড়ার ক্লাব – সর্বত্র ফুটবল যেন এক অদ্ভুত নেশা। কিন্তু এই আবেগের বীজ রোপণ যে বা যারা করেছিলেন তাঁরা আজ আলোচনার বাইরে। ফুটবলে একাধিক বিতর্কিত ঘটনার জেরে পিছনের সারিতে তাঁর অবদান।
বাংলার ফুটবল ইতিহাসের প্রথম অধ্যায় নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারীকে ছাড়া অসম্পূর্ণ
উপনিবেশিক বাংলায় ফুটবলের আগমন
ফুটবলের জন্ম ইংল্যান্ডে। ব্রিটিশরা যখন ভারতে এসে উপনিবেশ স্থাপন করে, তখন তাদের অফিসার ও সৈন্যরা অবসর সময়ে ফুটবল খেলতেন। বাংলার মাঠে ফুটবলের প্রথম পরিচয় ঘটে ১৮৭০-এর দশকে। কলকাতা তখন ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী, তাই কলকাতার ময়দানই ফুটবলের আঁতুড়ঘর হয়ে ওঠে।
সাদা থেকে রংচংয়ে জার্সি, সময়ের সঙ্গে কীভাবে বদলে যাচ্ছে ক্রিকেট
সেই সময় ফুটবল ছিল স্রেফ সাহেবদের খেলা। বাঙালিরা দূর থেকে দেখত, সাহেবরা জুতো পরে মাঠে নেমেছে ও সেই সময়ে বল ছিল চামড়ার। কিন্তু সাহস করে মাঠে নামার কথা তখনো কেউ ভাবেনি। প্রথম যে বাঙালি যুবক সাহেবদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ফুটবল খেলেছিলেন, তিনি ছিলেন নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী। শৈশবে নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী অজান্তে ফুটবলে লাথি মারলেও পরে সেটাকে গুরুত্ব দেন তিনি।
নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী: বাংলার ফুটবলের ‘জনক’
নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারীর নাম আজ অনেকেই শোনেননি, অথচ তিনিই বাংলায় এবং বলা যায় সমগ্র ভারতে সংগঠিত ফুটবলের প্রথম পথিকৃৎ। ১৮৬৯ সালে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করা নগেন্দ্রপ্রসাদ ছিলেন ডাফ কলেজের ছাত্র। তখন কলেজের পড়ুয়াদের মধ্যে পশ্চিমি খেলাধুলার প্রতি একটা কৌতূহল তৈরি হচ্ছিল। তবে সাহেবদের দাপটের কারণে স্থানীয়দের মাঠে নামা ছিল প্রায় অসম্ভব। নামলে সাহেবদের মার খেতে হতো।
১৮৭৭ সালে মাত্র ৮ বছর বয়সে নগেন্দ্রপ্রসাদ প্রথম ফুটবল খেলার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হন। তিনি ডাফ কলেজের মাঠে সাহেব ছাত্রদের সাথে ফুটবল খেলতেন। ধীরে ধীরে তিনি নিজের বন্ধুবান্ধবদের একত্রিত করে বাংলার প্রথম অ-সাহেব ফুটবল দল গঠন করেন, যার নাম ছিল ‘ওয়েলিংটন ক্লাব’। বলা হয়, বাংলার প্রথম ভারতীয় ক্লাব টিমও এটিই। যেটার ক্লাব ঘর ছিল বর্তমানে ময়দান চত্ত্বরে। কলকাতা তথা ভারতের পুরোনো ক্লাবগুলোর মধ্যে অধিকাংশের তাঁবু বা বর্তমানে অফিস এই ময়দান চত্ত্বরেই। সেনাবাহিনীর মালিকানাধীন ময়দানে তৈরি করা যায় কোনও পাকা কাঠামো, অস্থায়ী তাঁবু খাটিয়েই চলে ক্লাবগুলো।
কলকাতায় ফুটবল ক্লাবের ঐতিহ্য আর সমর্থকদের উন্মাদনা – সবকিছুর মূলেই আছে এই মানুষটির স্বপ্ন আর সাহস
প্রথম ভারতীয় ফুটবল ক্লাব
ওয়েলিংটন ক্লাব গড়ে ওঠার পর নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী কেবল নিজের জন্য খেলেননি; তিনি তখন থেকেই বাঙালি ছেলেদের মধ্যে খেলাধুলার প্রতি উৎসাহ তৈরি করতে থাকেন। তাঁর উদ্যোগে কলকাতার বিভিন্ন স্কুল ও কলেজের ছেলেরা ফুটবল খেলায় অংশ নিতে শুরু করে।
ওয়েলিংটন ক্লাব পরে ‘সোভারেন্স ক্লাব’ নামে নতুন রূপে আত্মপ্রকাশ করে। নগেন্দ্রপ্রসাদের প্রচেষ্টায় একসময় প্রতিষ্ঠিত হয় ‘জোড়াসাঁকো ক্লাব’। এই ক্লাবই পরে অন্য ভারতীয় ক্লাবগুলিকে অনুপ্রাণিত করে — যেমন শোভাবাজার ক্লাব, মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব এবং সবশেষে কিংবদন্তি মোহনবাগান।
চলছে ২২৫ বছর ধরে, কেন উইম্বলডনে সাদা পোশাক পরেন খেলোয়াড়রা?
সাহেবদের বিরুদ্ধে লড়াই: প্রথম বাঙালি জয়
নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী শুধু খেলোয়াড় ছিলেন না; তিনি ছিলেন সংগঠকও। সাহেবদের একচেটিয়া ফুটবল সংস্কৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করা সহজ ছিল না। সাহেবরা প্রথম দিকে ভারতীয় ক্লাবগুলিকে খেলতে দিত না, রেফারিংয়ে পক্ষপাতিত্ব করত, এমনকি স্থানীয়দের মাঠ ব্যবহার করতেও বাধা দিত।
কিন্তু ধীরে ধীরে নগেন্দ্রপ্রসাদ ও তাঁর ক্লাব সাহেব ক্লাবগুলির সাথে প্রতিযোগিতা করতে শুরু করে। শোনা যায়, তিনি একবার সাহেবদের মাঠে গিয়ে সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলেন — “আমরাও তোমাদের মতো খেলতে পারি!” একসময় সেই সাহেব দলগুলিকে হারিয়ে বাঙালির ফুটবল আত্মসম্মান নতুন মাত্রা পায়।
নগেন্দ্রপ্রসাদের অবদান: ফুটবল থেকে স্বাধীনতা-চেতনা
নগেন্দ্রপ্রসাদের ফুটবল আন্দোলন শুধু খেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। তখন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সরাসরি রাজনৈতিক বিদ্রোহে যেতে ভয় পেতেন অনেকে। কিন্তু ফুটবলের মাঠে সাহেবদের হারানো মানে ছিল ‘গৌরবের লড়াই’। ব্রিটিশদের শাসনের বিরুদ্ধে মনস্তাত্ত্বিক জয়। এই মানসিকতাই পরবর্তী প্রজন্মকে স্বাধীনতা সংগ্রামে সাহস জুগিয়েছিল।
এ কারণেই ১৯১১ সালে মোহনবাগানের IFA শিল্ড জয় আলাদা মাত্রা যোগ করে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে।
তিনি না থাকলে হয়তো কলকাতা ময়দানে আজকের মতো গর্বের ফুটবল সংস্কৃতি গড়ে উঠত না
নগেন্দ্রপ্রসাদের উত্তরাধিকার: বাংলার ক্লাব কালচার
নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারীর শুরু করা ক্লাব সংস্কৃতিই কলকাতা ময়দানের বিখ্যাত ক্লাব কালচারের ভিত্তি। কলকাতায় ফুটবল ক্লাবের ঐতিহ্য আর সমর্থকদের উন্মাদনা – সবকিছুর মূলেই আছে এই মানুষটির স্বপ্ন আর সাহস। কলকাতা ময়দানের ইতিহাস লিখতে গেলে এঁর নাম একটা বড় অংশজুড়ে থাকবে।
আজ মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, মহামেডান স্পোর্টিং-এর মধ্যে তীব্র লড়াই হলে আমরা উপভোগ করি, কিন্তু নগেন্দ্রপ্রসাদের সময়ে এ ধরনের সুযোগ কল্পনাতেও ছিল না। তিনি ক্লাব তৈরি করেছিলেন সাহেবদের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের একতা গড়তে। ফুটবল তাঁর হাতে হয়ে ওঠে সামাজিক পরিবর্তনের হাতিয়ার। এর পর সেটা ধীরে ধীরে প্রতিযোগিতায় পরিণত হয়, আরও ক্লাব আসে এবং ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে।
আজকের প্রজন্ম কতটা জানে?
দুঃখের বিষয়, আজকের ফুটবলপ্রেমী প্রজন্মের অনেকেই নগেন্দ্রপ্রসাদের নাম শোনেননি। স্কুলের ইতিহাস বইয়ে তাঁর কথা নেই। কোনো বড় স্টেডিয়াম বা গ্যালারি তাঁর নামে নামকরণ হয়নি। অথচ তিনি না থাকলে হয়তো কলকাতা ময়দানে আজকের মতো গর্বের ফুটবল সংস্কৃতি গড়ে উঠত না।
বিভিন্ন ক্রীড়া গবেষক, ইতিহাসবিদ এবং ফুটবল সংগঠন বারবারই দাবি করেছেন, নগেন্দ্রপ্রসাদের অবদানকে স্কুলের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বাংলার ফুটবলের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তাঁকে নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে হবে। যদিও তাঁকে নিয়ে তৈরি সিনেমা গোলন্দাজের (Nagendra Prasad Sarbadhikari Biography) হাত ধরে অনেকেই তাঁর ব্যাপারে জেনেছেন।
বাংলার ফুটবল ইতিহাসের প্রথম অধ্যায় নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারীকে ছাড়া অসম্পূর্ণ। সাহেবদের একচেটিয়া ফুটবল সংস্কৃতিকে ভেঙে বাঙালির হাতে বল তুলে দেওয়া সহজ কাজ ছিল না। সাহসিকতা, সংগঠন ক্ষমতা আর অদম্য জেদ দিয়ে তিনি সেটাই করেছিলেন।
ফুটবল বাংলার রক্তে মিশে আছে। সেই রক্তে প্রথম স্পর্শ এনেছিলেন নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী। তাই আগামী প্রজন্মের কাছে তাঁর গল্প ছড়িয়ে দেওয়া আমাদের দায়িত্ব। আর ফুটবল মাঠে যখনই নতুন গোল হবে, গ্যালারি গর্জে উঠবে — সেই শব্দে কোথাও না কোথাও বাংলার প্রথম ফুটবলারের আত্মার হাসি শুনতে পাওয়া যাবে, ইতিহাসের গহীনে।
তথ্যসূত্র
- History of Indian Football – Novy Kapadia
- Goal: The Story of Indian Football – Boria Majumdar
- Various IFA Annual Reports
- Rabindra Bharati University Research Papers
- বিভিন্ন সংবাদপত্র (অনলাইন, অফলাইন)
Discover more from Unknown Story
Subscribe to get the latest posts sent to your email.
Leave a ReplyCancel reply