টেনিসের অন্যতম সম্মানের গ্র্যান্ডস্ল্যাম হচ্ছে উইম্বলডন। প্রত্যেক টেনিস তারকার জীবনে স্বপ্ন থাকে তাঁদের ট্রফি ক্যাবিনেটে যেন একটা উইম্বলডন থাকে। কেউ পারেন, আবার কেউ পারেন না। বছরের পর বছর ধরে চলা উইম্বলডনও একাধিক ইতিহাস বহন করছে। উইম্বলডনের ক্লাস থেকে শুরু করে নিয়ম, সবকিছু নিয়মে চলছে।
এই নিয়মগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে সাদা পোশাক। পুরুষ থেকে মহিলা সকলেই এখানে সাদা পোশাক পরে খেলতে নামেন। অন্যদিকে উইম্বলডনে যেই VIP-রা খেলা দেখতে যান, তাঁরাও ব্লেজার পরে খেলা দেখেন।
সাদা থেকে রংচংয়ে জার্সি, সময়ের সঙ্গে কীভাবে বদলে যাচ্ছে ক্রিকেট
কেন উইম্বলডনে সাদা পোশাক পরে খেলতে হয়? জানুন বিস্তারিত
উইম্বলডন টেনিস চ্যাম্পিয়নশিপের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
টেনিসের সবচেয়ে প্রাচীন আর মর্যাদাপূর্ণ আসর উইম্বলডন। প্রত্যেক প্লেয়ারের স্বপ্ন থাকে উইম্বলডনে খেলতে নামার। টেনিস প্রেমীদের কাছেও স্বপ্ন থাকে উইম্বলডনে বসে খেলা দেখার।
এই প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল ১৮৭৭ সালে, লন্ডনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল উইম্বলডনের অল ইংল্যান্ড ক্লাবের (All England Lawn Tennis and Croquet Club) মাঠে।
প্রথমে শুধু পুরুষদের জন্য এই টুর্নামেন্ট ছিল, পরে ধাপে ধাপে যুক্ত হয়েছে মহিলা, ডাবলসের ইভেন্ট।
প্রায় দেড়শ বছরেরও বেশি সময় ধরে উইম্বলডন শুধুমাত্র খেলার জন্য নয়, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির অন্যতম উদাহরণ। ব্রিটিশরা তাদের ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে, সেটার উদাহরণ হচ্ছে এই উইম্বলডন।
উইম্বলডনের অনন্য বৈশিষ্ট্য
- এটি বিশ্বের একমাত্র গ্র্যান্ড স্ল্যাম টুর্নামেন্ট যা শুধুমাত্র ঘাসের কোর্টে খেলা হয়, শুরু থেকে এখনও পর্যন্ত এই নিয়ম চলে আসছে
- ম্যাচের মধ্যে ব্রেকের সময় স্ট্রবেরি ও ক্রিম খাওয়ার ঐতিহ্য শত বছরের বেশি পুরনো, প্লেয়াররা ডায়েট ম্যানেজ করে এটা করে থাকেন
- এরসঙ্গে রয়েছে প্লেয়ারদের সাদা পোশাক
কেন উইম্বলডনে খেলোয়াড়রা সাদা পোশাক পরেন?
উইম্বলডনের ‘অল হোয়াইট ড্রেস কোড’ আজকের দিনে নিয়মরক্ষার বিষয় নয়, বরং ঐতিহ্য আর আভিজাত্যের অংশ।
১৮০০ সালের শেষের দিকে টেনিস পরিচিত ছিল ‘লন টেনিস’ নামে। সেই সময়কার অভিজাত সমাজে লন টেনিস খেলার সময়ে সাদা পোশাক পরতে হতো। কারণ রঙিন পোশাকে ঘাম ও দাগ স্পষ্ট দেখা যেত যা। আর তখন মনে করা হতো অভিজাত ক্লাসের সঙ্গে ঘামের দাগ যায় না।
উইম্বলডন এই ঐতিহ্যকে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করে। ১৯৬৩ সালে অল ইংল্যান্ড ক্লাব অফিসিয়ালি খেলোয়াড়দের জন্য এই নিয়ম চালু করে — খেলোয়াড়দের জার্সি, হেডব্যান্ড, জুতো এবং আন্ডারগার্মেন্টস পর্যন্ত সাদা হতে হবে। লোগো থাকলেও তার রঙ ১ সেন্টিমিটারের বেশি হতে পারবে না।
দাবাকে দাবায়ে রাখতে পারবা না, দাবাকে জানতে হবে
কী বলা আছে উইম্বলডনের ড্রেস কোডে:
-
-
- শার্ট, স্কার্ট, ট্রাউজ়ার: সম্পূর্ণ সাদা
- আন্ডারগার্মেন্টস: হেমলাইন বা নেকলাইনের বাইরে দৃশ্যমান হলে সেটিও সাদা হতে হবে
হেডব্যান্ড, রিস্টব্যান্ড: সাদা - জুতো: সাদা, সামান্য কালো সোল থাকলেও চলবে
-
উইম্বলডনের এই নিয়ম এতই কঠোর যে ২০১৩ সালে রজার ফেডেরারকে পর্যন্ত সতর্ক করা হয়েছিল। তাঁর জুতোর একটা অংশে কালো রং ছিল।
এত বছরের পুরোনো ড্রেসকোড কেন এখনও মানা হয় উইম্বলডনে?
খেলোয়াড় ও সমর্থকদের একাংশ মনে করে, আধুনিক যুগে এর যৌক্তিকতা নেই। তবুও অল ইংল্যান্ড ক্লাব অবশ্য অন্য জিনিস মনে করে। তাদের মতে-
- এটার মধ্যে দিয়ে ঐতিহ্য বজায় রাখা যাবে
- ‘লন টেনিস’ এর আভিজাত্য ধরে রাখা
- মাঠে খেলোয়াড়দের সৌন্দর্য ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা
এটি এক ধরনের ‘ব্র্যান্ড আইডেন্টিটি’। অন্য কোনও গ্র্যান্ড স্ল্যাম বা মাস্টার্স ইভেন্টে এমন নিয়ম নেই — ফলে উইম্বলডন আলাদা।
ড্রেস কোড ভাঙলে কী হয়?
ড্রেস কোড না মানলে খেলোয়াড়কে ম্যাচের মাঝপথে পোশাক পরিবর্তন করতে বলা হয়। ম্যাচ অফিসিয়ালরা প্রতিটি খেলোয়াড়ের পোশাক আগেই যাচাই করেন। কোনো সন্দেহ হলে ম্যাচের আগেই তা বদলাতে বলা হয়।
একবার মার্কিন খেলোয়াড় অ্যান্ড্রেয়া পেতকোভিচকে স্কার্ট পরিবর্তন করতে হয়েছিল। সেই ছবি তখন মিডিয়ায় ছড়িয়ে যায় — এবং বিতর্কও হয়।
উইম্বলডনের টিকিটের দাম কত? ও বুকিং করবেন কী ভাবে?
উইম্বলডনের আরেকটি বড় বিষয় — টিকেট সিস্টেম। অল ইংল্যান্ড ক্লাব কিছু টিকিট বিক্রি করে ‘Public Ballot’ নামে লটারি সিস্টেমে। এছাড়া কিছু VIP ও সদস্যদের জন্য সংরক্ষিত থাকে।
- সেন্টার কোর্টের ফাইনাল ম্যাচ: প্রায় ২৫,০০০–২৮,০০০ টাকার মধ্যে
- আর্লি রাউন্ড: ৬ থেকে ১৭ হাজারের মধ্যে
- কোর্ট ১ বা ২: কিছুটা কম
উইম্বলডনে ম্যাচ দেখতে গেলে কী কী নিয়ম মানতে হবে?
আপনি টিকিট কেটে গিয়ে উইম্বলডনে খেলা দেখতে পারবেন না। এরজন্য আপনাকে মানতে হবে বেশ কিছু নিয়ম।
-
- Public Ballot: বছরের শুরুর দিকে অনলাইনে আবেদন করতে হয়। লটারির ভিত্তিতে টিকিট মেলে। ফলে আগে থেকে আবেদন করা দরকার।
- The Queue: উইম্বলডনের আরেক ঐতিহ্য হলো লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কেনা। অনেকে রাতেই লাইনে বসে থাকেন, তাঁবু খাটিয়ে ক্যাম্প করেন। প্রতি দিন কিছু ‘গ্রাউন্ড পাস’ ও কোর্টের টিকিট ‘The Queue’ থেকে বিক্রি হয়।
- ডেবেন্টার টিকিট: সবচেয়ে এক্সক্লুসিভ, দামের দিক থেকেও সবচেয়ে বেশি। কর্পোরেট বা বড় স্পন্সররা কিনে থাকেন। এগুলো পুনরায় বিক্রি বা রিসেল করা যায়।

অনুশীলনে রঙিন পোশাক পরলেও ইভেন্টে অ্য়ালাউ নেই
উইম্বলডনের প্রভাব টেনিস ফ্যাশনে
উইম্বলডনে সাদা পোশাক মানে সেটাকে ফ্যাশনলেস ভাববনে না। এটা একটা ফ্যাশন স্টেটমেন্ট। এটা ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিকে প্রভাবিত করেছে। বড় বড় স্পোর্টস ব্র্যান্ড (Nike, Adidas, Lacoste) উইম্বলডনের জন্য সাদা পোশাকের বিশেষকালেকশন বানায়।
সমালোচনা ও বিতর্ক
আধুনিক সময়ে অনেকেই মনে করেন, এই ধরনে কড়াকড়ির দরকার নেই। বিশেষ করে অন্তর্বাসের রং ঠিক করে দেওয়াতে আপত্তি অধিকাংশের। ২০২২ সালে কিছু খেলোয়াড় এই নিয়ম শিথিল করার দাবি তোলেন, তাতেও পরিবর্তন হয়নি।
উইম্বলডন সেলিব্রিটিদের আঁতুরঘর
উইম্বলডন শুধু খেলা নয় — এটি এক ধরনের ‘সামাজিক মর্যাদা’। এখানে বসে খেলা দেখা মানে সমাজে অনেকটাই উপরে নিজেকে নিয়ে যাওয়া। ব্রিটেনের রাজপরিবারের সদস্য থেকে শুরু করে বিশ্বের বড় বড় সেলিব্রিটি, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী সবাই স্ট্যান্ডে বসে খেলা উপভোগ করেন।
ব্রিটিশদের থেকে বল কেড়ে বাঙালিকে ফুটবল খেলা শেখান নগেন্দ্রপ্রসাদ
এটি ব্রিটিশ রাজ পরিবারের এক ঐতিহ্যের অংশও বটে। কিং চার্লস বা প্রিন্সেস ডায়ানা থেকে শুরু করে প্রিন্স উইলিয়াম ও কেট মিডলটন — সবাই উইম্বলডনে নিয়মিত অতিথি ছিলেন ও আছেন।
উইম্বলডন আমাদের শিখিয়ে দেয় — ঐতিহ্য আর আধুনিকতার মধ্যে সমন্বয় কী ভাবে সম্ভব। যখন খেলোয়াড়রা ঘাসের কোর্টে সাদা পোশাক পরে ছুটে চলেন, তখন শুধু ম্যাচই নয় — জীবন্ত হয় ইতিহাস।
তথ্যসূত্র:
Wimbledon Official Site
BBC Sport Wimbledon Archives
ESPN Tennis Coverage
The Guardian: Wimbledon’s All-White Dress Code Explained
ATP & WTA Player Interviews
Documentary: Wimbledon — The Story of the Championships (BBC)
Wimbledon Annual Report: Ticket Prices & Revenue
Discover more from Unknown Story
Subscribe to get the latest posts sent to your email.
Leave a Reply