ডেকার্স লেন: রাস্তা নয়, কলকাতার স্ট্রিট ফুড স্বর্গ


কথায় আছে মুম্বই, দিল্লি, কলকাতা, চেন্নাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে সস্তা শহর কলকাতা। এখানে যেমন ২০ টাকায় ব্রেকফাস্ট হয় তেমনই ৩০-৪০ টাকায় দুপুর বা রাতের খাবারও হয়ে যায়।

তাই বেশি থেকে কম বেতন, সকলের প্রিয় শহর সিটি অফ জয়।

তবে কলকাতাকে সস্তা শহরের তকমা পেতে যেটা সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে সেটা হচ্ছে একটা রাস্তা। যার নাম জেমস হিকি সরণী।

নামটা শুনে অনেকের কাছেই নতুন লাগতে পারে। আসলে খাতায় কলমে জেমস হিকি সরণী হলেও এটার নাম হয়ে গিয়েছে ডেকার্স লেন। কর্মরত বাঙালির সেরা ঠিকানা।

কলকাতা শহরের এমন কিছু রাস্তা আছে যেগুলি কেবল চলাচলের জন্য নয় — শহরের প্রাণ, শহরের গল্প আর শহরের স্বাদ বহন করে। সেই তালিকায় অন্যতম এটি। যা অফিসপাড়ার মধ্যেই এক বিস্ময়কর স্ট্রিট ফুড স্বর্গ।

একে অনেকে ‘কলকাতার ফুড লেন’ বললেও, এর পিছনে আছে উপনিবেশিক কলকাতার ইতিহাস, সমাজ আর সংবাদপত্র সংস্কৃতির অজানা অধ্যায়। এই লেখায় জেনে নিন সেটারই ইতিহাস-

কলকাতার কেন্দ্রস্থলে ডেকার্স লেন

ডেকার্স লেন আসলে কলকাতার বিশিষ্ট রাস্তা — যার সরকারি নাম জেমস হিকি সরণি (James Hickey Sarani)। এটি কলকাতার চিফ জজ কোর্টের কাছে, এসপ্ল্যানেডের পিছনে, রাজভবনের একদম অদূরে।

একসময় এই রাস্তাটি ছিল কলকাতার সরকারি দপ্তর, হাইকোর্ট আর প্রেসিডেন্সি কলেজের শিক্ষিত অফিসযাত্রীদের লাঞ্চ ব্রেকের গন্তব্য।

শুধু অফিসযাত্রী নয় — ডেকার্স লেনের খাবার খেতে দূরদূরান্ত থেকেও মানুষ আসেন।

কলকাতার বাইরে থেকে যারা প্রতিদিন শহরে আসেন বিভিন্ন কাজে, তাদের পেট ভরতে ডেকার্স লেন সেরা গন্তব্য।

James Hickey Sarani থেকে Dacres Lane: কী ভাবে বদলে গেল নাম?

ডেকার্স লেনের সরকারি নাম জেমস হিকি সরণি কেন? জেমস অগাস্টাস হিকি ছিলেন ভারতের প্রথম মুদ্রিত সংবাদপত্র বেঙ্গল গেজ়েটের সম্পাদক।

১৭৮০ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল এই পত্রিকা। হিকির ছাপাখানা এই অঞ্চলে ছিল বলে এই রাস্তার নামকরণ করা হয়েছিল James Hickey Sarani।

এটা শোনার পর আপনার প্রশ্ন জাগতেই পারে, অমন সুন্দর নামটা ডেকার্স লেন হলো কী করে? এটা নিয়ে নানা মুণির নানা মত আছে।

ইতিহাসবিদদের একাংশের মতে, যেহেতু কাছেই গঙ্গা তাই সেখানে জাহাজ আসত। আর জাহাজের খালাসিরা এই রাস্তায় এসে খাবার খেতেন।

যেহেতু জাহাজ ডেক করার পর খালাসিরা আসতে পারতেন, তাই সেখান থেকে ডেকার্স নাম হয়।

আবার অপর অংশের মতে, এই নামের পিছনে আছে D’Acres নামের এক ব্রিটিশ বণিক বা অফিসার, যিনি আঠারোশো শতকে এই অঞ্চলে ব্যবসা করতেন এবং থাকতেন।

ধীরে ধীরে স্থানীয়রা রাস্তাটিকে D’Acres Lane নামে ডাকতে শুরু করে, যা পরবর্তীতে ডেকার্স লেন নামে প্রচলিত হয়।

কলকাতার ঔপনিবেশিক ইতিহাসে ডেকার্স লেনের ভূমিকা

ডেকার্স লেন শুধু খাবারের গলি নয় — এটি কলকাতার ব্রিটিশ শাসনের সময়কাল থেকে শহরের ‘শাসনকেন্দ্র’-এর এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কেন?

  • এই অঞ্চলের চারপাশেই ছড়িয়ে ছিল কলকাতার সরকারি দপ্তর, হাইকোর্ট, পোস্ট অফিস, রাজভবন, ব্যাংকিং সেক্টর।
  • কলকাতার প্রথম ছাপাখানার ঠিকানা কাছেই ছিল। এখান থেকে দেশের সংবাদপত্র ইতিহাসের শুরু।
  • কলকাতার অফিস-সংস্কৃতি, অর্থাৎ ‘৯ টা–৫ টা’র অফিসপাড়ার খাবার খাওয়ার ট্র্যাডিশন শুরু হয় এই লেনকে ঘিরেই।

অফিসপাড়ার দুপুর মানেই ডেকার্স লেন

একটা সময়ে কলকাতার বড় বড় কোর্টের ব্যারিস্টার, সরকারী কেরানি থেকে ব্যাংকের বড় অফিসার — সবাই দুপুরে ছুটে আসতেন ডেকার্স লেনে। মাত্র কয়েক টাকা পকেটে থাকলেই এখানে পেটপুজো সম্ভব।

এখনও সেই চিত্র খুব একটা বদলায়নি। শুধু আইটেম আর দোকান বেড়েছে, খাবারের স্বাদও বহুমুখী হয়েছে। তিরিশ বছর ধরে দাঁড়িয়ে থাকা দোকান থেকে শুরু করে নতুন জেনারেশনের দোকানও আছে এখানে।

চিত্তবাবুর দোকান

চাইনিজ, ভেজ-ননভেজ, কাটলেট, চপ, মোগলাই পরোটা, চিকেন স্টু, চা-বিস্কুট, ফলের রস — এক কথায় শহরের মধ্যেই এক স্ট্রিট ফুড কার্নিভাল।

কীভাবে যাবেন ডেকার্স লেনে?

যে কোনও প্রান্ত থেকে খুব সহজেই পৌঁছে যাবেন ডেকার্স লেনে।

  • ডেকার্স লেনের কাছের মেট্রো: এপ্ল্যানেড মেট্রো স্টেশন থেকে হাঁটা পথ মাত্র ৫ মিনিট।
  • ডেকার্স লেনের কাছের বাসস্ট্যান্ড: ধর্মতলা, লালবাজার, হাইকোর্ট, বিবাদী বাগ — যে কোনও বাস ধরলে নেমে হেঁটেই পৌঁছে যাবেন।
  • ট্যাক্সি/অ্যাপ ক্যাব: ‘James Hickey Sarani’ বা ‘Dacres Lane’ বললেই গুগল ম্যাপ দেখে ক্যাব সহজেই নিয়ে আসবে।

ডেকার্স লেনের ভালো দিক ও খারাপ দিক

ভালো দিক

  • সাধ্যের মধ্যে দুর্দান্ত খাবার
  • ইতিহাসের ছোঁয়া আর অফিসপাড়ার সস্তা খাওয়ার বিকল্প
  • রাত পর্যন্ত খাবারের বাহার
  • কোনও ডাইনিং চার্জ নেই — দাঁড়িয়ে বা চেয়ারে বসেই খেতে পারেন

খারাপ দিক

  • ভিড় বেশি — দুপুর ১টা–৩টা সময় সবচেয়ে চাপ
  • হাইজিন সব দোকানে সমান নয় — রাস্তার খাবার খাওয়ার আগে একটু সচেতন থাকাই ভালো
  • বসার ব্যবস্থা সীমিত — বেশি মানুষ গেলে বসার জায়গা পেতে কষ্ট হতে পারে
  • ট্রাফিক জ্যাম — গলিপথে বেশি গাড়ি ঢোকে না, হাঁটতে হয়

কেন ডেকার্স লেন কলকাতার গুরুত্বপূর্ণ অংশ?

ডেকার্স লেন শহরের স্ট্রিট ফুড কালচারের অফিসিয়াল হাব। একে বলা যায় কলকাতার ফুড হেরিটেজ স্পট।

কারণ এখানে শুধু খাবার নয়, শহরের বহু অফিসপাড়ার কর্মসংস্কৃতি, মেমোরি আর গল্প লুকিয়ে আছে।

যখন অন্য শহরের মানুষ বলেন, কলকাতা স্ট্রিট ফুডের রাজধানী — তার নেপথ্যে ডেকার্স লেনের অবদান অস্বীকার করা যায় না।

 

ডেকার্স লেন নিয়ে নতুন প্রজন্মের কাছে কী বার্তা?

বর্তমান প্রজন্ম ফুডকোর্টে খেতে ভালোবাসে — কিন্তু কলকাতার আসল স্বাদ খুঁজে পেতে হলে একবার অন্তত ডেকার্স লেনে যেতে হবে।

ছোট দোকান, বড় গল্প আর রাস্তার ধুলোয় মিশে থাকা শহরের আসল স্বাদ — সবই এখানে।

কলকাতা যদি হয় ‘সিটি অফ জয়’, তাহলে ডেকার্স লেন নিঃসন্দেহে সেই জয়ের স্ট্রিট ফুড মক্কা। অফিসপাড়ার ব্যস্ততা, রাজভবনের ছায়া, ইতিহাসের গল্প আর হাজারো মানুষের খিদে — সব একসঙ্গে মিলেমিশে তৈরি করেছে এই রাস্তার স্বাদ।


তথ্যসূত্র:
Calcutta: The Living City – Sukanta Chaudhuri (Oxford India Paperbacks)
Food Streets of Kolkata – Times of India Archives
James Hickey and the Bengal Gazette – Various British Library Records
Kolkata Municipal Corporation Website
Heritage Walk Calcutta – Local Archives; Guides



Discover more from Unknown Story

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Exit mobile version