কলকাতার বিজলি রোড, ইতিহাসের সাক্ষী এক চিলতে রাস্তা

calcutta tram history

বিজলি রোড চেনেন? প্রশ্নটা শুনে অবাক হওয়ার কিছু নেই। যারা পুরোনো কলকাতার আদি বাসিন্দা বা স্থানীয় নন তাদের পক্ষে বিজলি রোড চেনার কথা নয়। জানলে তো খুব ভালো, আর না জানলে জেনে নিন ঐতিহাসিক বিজলি রোডের গল্প।

কোথায় অবস্থিত বিজলি রোড?

কলকাতায় মল্লিকবাজার থেকে ট্রাম-লাইন যেখানে এলিয়ট রোডের দিকে বাঁক নিয়েছে, ঠিক তার উল্টো দিকেই রয়েছে নোনাপুকুর ট্রাম ডিপো। অনেকে এই রাস্তাটাকে বলেন লোয়ার সার্কুলার রোড। ব্রিটিশ আমলে সেই নাম বদলে হয় আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোড। যা বেশি পরিচিত AJC Bose Road নামে।

এই নোনাপুকুর ট্রাম ডিপো এখন ট্রামের মতোই ধুঁকছে কলকাতায়। যে ভাবে ট্রামের মৃত্যু হচ্ছে তাতে খুব শীঘ্রই এই ডিপো ইতিহাস হয়ে যাবে। দেখতে ধূসর, সে ভাবে কোথাও নাম উল্লেখ করা নেই। কিন্তু এই জায়গাটি ঐতিহাসিক।

কেন ঐতিহাসিক এই ট্রাম ডিপো?

কলকাতা থেকে ট্রাম পুরোপুরি উঠে গেলে সেটা ইতিহাস হয়ে যাবে, তখন সেটা হবে ঐতিহাসিক। সেটা তো গেল আলাদা কথা। কিন্তু এই ট্রাম ডিপোটি ট্রাম ছাড়াও আরও নানা কারণে বেশ বিখ্যাত।

‘কাহানি’, ‘পিকু’ এমন আরও নানা ছবির শুটিং হয়েছে এই ডিপোতে। ফলে অনেক তারকা এসেছেন। সেটাও বিখ্যাত হওয়ার একটা কারণ। তবে আজকের লেখাটা বিজলি নিয়ে। সেই বিষয়ে আসি।

বিজলি রোড বলতে গেলে সেখানে জেনারেটর আসবে। কারণ জেনারেটরই বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। এই জেনারেটরের সঙ্গে কলকাতার সম্পর্ক বা এই জেনারেটের জন্যই ইতিহাস।

ইতিহাসের কলকাতায় ছড়িয়ে ভূতের বাড়ি, জানেন ইতিহাস?

কী এই বিজলি রোড? কী করে নাম হলো?

ওই এলাকায় গেলে বা একটু ঘুরে দেখলে খেয়াল করবেন ট্রামডিপোর ঠিক লাগোয়া রাস্তায় একটা বোর্ডে লেখা ‘বিজলি রোড’। সাধারণভাবে দেখলে পাবেন না। খুঁজতে গেলে বেশ খাটতে হবে।

খুঁজে পেলে ভালো, না পেলেও আপত্তি নেই। তবে সেই বিজলি রোড ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে রয়েছে।

আসলে, নোনাপুকুর ট্রামডিপোতে তখনকার দিনের ক্যালকাটা ট্রামওয়েজ কোম্পানি বিদ্যুৎ তৈরির জন্য প্রথম একটি নিজস্ব জেনারেটর বসিয়েছিল। আর এই জেনারেটরই বদলে দিয়েছিল ভারতের তৎকালীন রাজধানী কলকাতার ছবি।

nonapukur tram depo location

বিজলি পথের গল্প

আমরা সকলেই জানি, এক সময় কলকাতায় ট্রাম টানত ঘোড়া। ১৮৭৩-এর ২৪ ফ্রেব্রুয়ারি শিয়ালদহ রেল স্টেশন থেকে আর্মেনিয়ান ঘাট পর্যন্ত ঘোড়ায়-টানা ট্রাম চালু হল।

গোড়ায় কোম্পানি চেয়েছিল, এই ট্রাম মালপত্রই বইবে, মানুষ নয়। বাস্তবে দেখা গেল, প্রথম দিন থেকে সেখানে মানুষই চড়েছে এবং প্রায় বিনা পয়সায়। ফলে মাত্র সাতটি মাস চালানোর পর লোকসান এতটাই যে, বন্ধ করে দিতে হল সেই ট্রাম সার্ভিস।

এর পর ১৮৮০-র ১ নভেম্বর থেকে ফের নতুন করে ট্রামযাত্রা শুরু হলো কলকাতায়। এ বারের বাহনও সেই ঘোড়া। প্রথমে চালানো হল সেই পুরনো পথেই, অর্থাৎ, শিয়ালদহ থেকে আর্মেনিয়ান ঘাট পর্যন্ত।

তার পর একে একে চৌরঙ্গি রোড, চিৎপুর রোড, ধর্মতলা স্ট্রিট, স্ট্র্যান্ড রোড, শ্যামবাজার, খিদিরপুর, ওয়েলেসলি স্ট্রিট। তখন ব্রিটিশ রাজত্বের সাধের শহর কলকাতা। দেশ-বিদেশ থেকে মানুষ বাসা করছে এই শহরে। পাল্লা দিয়ে ট্রামের জনপ্রিয়তাও বাড়তে লাগল। আরও নতুন নতুন রাস্তায় পৌঁছে গেল ট্রাম।

ট্রাম বাড়ায় সুবিধা তো হলোই, কিন্তু সমস্যাও বাড়ল। যেহেতু ঘোড়া টানত তাই তাদের মর্জির উপর অনেক কিছু নির্ভর করত। ঘোড়া ভয় পেয়ে গেলে বা কোনও পিছন পাকা বাচ্চা ঘোড়াকে খুঁচিয়ে দিলে তখন হতো কেলেঙ্কারি কাণ্ড।

ভারতে প্রথম, কলকাতা মেট্রোর ইতিহাস, সম্প্রসারণ ও বর্তমান চিত্র

ঘোড়ার দৌড়াদৌড়িতে গাড়ি ছিটকে যেত লাইন থেকে। এতে অনেক মানুষ আহত হন। এরপর ট্রাম কোম্পানি দেখল ঘোড়া দিয়ে হবে না। তাই কিছু রাস্তায় ঘোড়ার বদলে স্টিম ইঞ্জিন দিয়ে ট্রাম চালানোর পরিকল্পনা নেওয়া হলো। কিন্তু সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে বেশ বেগ পেতে হয়।

ফুলপ্রুফ প্ল্যান বের করতে সাহায্য নেওয়া হয় বিদ্যুতের। তত দিনে কলকাতায় বিদ্যুৎ এসে গিয়েছিল। ইংল্যান্ডের ‘দি ইন্ডিয়ান ইলেক্ট্রিক কোম্পানি লিমিটেড’-এর পক্ষে ‘কিলবার্ন অ্যান্ড কোম্পানি’ কলকাতা শহরে ইলেক্ট্রিক সাপ্লাইয়ের লাইসেন্স পেয়েছে।

history of ctc

মাসখানেকের মধ্যেই সেই কোম্পানির নাম পাল্টে হল ‘দি ক্যালকাটা ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই কর্পোরেশন লিমিটেড’ এখন যেটা CESC। সেই কোম্পানি প্রিন্সেপ স্ট্রিটের কাছে ইমামবাগ লেনে ‘ক্রম্পটন’ ডায়নামো, ‘উইলান্স’ ইঞ্জিন এবং ‘বেকক অ্যান্ড উইলকক্স’ বয়লারের সাহায্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র তৈরি করল।

ট্রাম কোম্পানি দেখল এটাই সুযোগ। শহরে বিদ্যুৎ থাকতে ঘোড়া দিয়ে ট্রাম চালাব কেন? তারা সরকারের কাছে এই বিষয়ে অনুমতি চাইল। অনুমতি পেতে দেরি হয়নি। ১৯০২-এর ১৪ জুন খিদিরপুরে চালু হল প্রথম ইলেক্ট্রিক ট্রাম। তার পর ধাপে ধাপে কলকাতার সমস্ত রাস্তায়।

বৈদ্যুতিন ট্রামের সমস্যা

তবে এতেও দেখা গেল সমস্যা। এত বিদ্যুৎ মিলবে কী করে? সদ্য শহরে বিদ্যুৎ এসেছিল, সেটা থেকে শহরকে আলোকিত না করে ট্রাম চালাতে গেলে সমস্যা বাড়বে। আর এত বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ সরবরাহের মতো পরিকাঠামো ছিল না।

এই সমস্যা থেকে বাঁচতে ট্রাম কোম্পানি ঠিক করল, আত্মনির্ভর হবে। নিজেদের বিদ্যুৎ নিজেরাই তৈরি করবে। সেটার জন্য বেছে নেওয়া হলো নোনাপুকুর ট্রামডিপোকে। সেখানে বসানো হল একটি জেনারেটর।

tram depo

গোটা দেশের মধ্যে সেই প্রথম। কলকাতা শহরের বুকে নিজস্ব বিদ্যুৎ দিয়ে ট্রাম চালাচ্ছে ট্রাম কোম্পানি। প্রথম তো বটেই, বেনজিরও। আর যেখানে এটা হয়েছিল, সেটার নাম বদলে হয়ে গেল বিজলি রোড। সঙ্গে ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিল।

এখন যেই ট্রাম চালিয়ে কর্মীদের বেতন উঠছে না, সেই ট্রাম একটা সময়ে নিজস্ব বিদ্যুতে চলত। ধীরে ধীরে ট্রামও বন্ধ হয়ে যাবে এবং পুরোটাই ইতিহাসের পাতায় চলে যাবে।

এই লেখাটি একাধিক বই, সংবাদপত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করে তৈরি করা



Discover more from Unknown Story

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Leave a Reply