ভারতে প্রথম, সাক্ষী স্বাধীনতা আন্দোলনের, জেনে নিন কলকাতা হাইকোর্টের ইতিহাস


কথায় আছে বাঙালকে হাইকোর্ট দেখাবেন না। ধীরে ধীরে এই প্রবাদে বাঙালটা বদলে হয়েছে বাঙালি। যার অর্থ, বাঙালিদের বোকা বানানো যাবে না। ঠিক যেমন হাইকোর্টকে বোকা বানানো যায় না, সেটাকেই এখানে তুলে ধরা হয়েছে। মানুষ বিচার পেতে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন। দেশের প্রতিটা রাজ্যে হাইকোর্ট থাকলেও ভারতের হাইকোর্টের গুরুত্ব আলাদা। কলকাতার কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে থাকা এই লাল বাড়িটার প্রতিটা ইটে লেখা আছে ইতিহাস। unknownstory.in-এ জেনে নিন সেই ইতিহাসের কিছু অংশ।

কলকাতা হাইকোর্টের ইতিহাস

কলকাতা হাইকোর্টের যাত্রা শুরু হয় ১৮৬২ সালের ১ জুলাই। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতের প্রশাসনিক কাঠামো সাজানোর জন্য কলকাতাকে রাজধানী হিসেবে বেছে নিয়েছিল। আর সেই সময়ে বিচার ব্যবস্থা সামলানোর জন্য তারা আদালত তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। তখনকার সুপ্রিম কোর্ট অফ জুডিকেচার ১৭৭৪ সালে স্থাপিত হলেও পরবর্তীতে চার্টার অ্যাক্ট ১৮৬১-এর মাধ্যমে হাইকোর্ট গঠনের রাস্তাটি সুগম হয়।

ছিল ইংরেজদের দপ্তর, এখন ডাকঘর, জেনে নিন কলকাতা GPO-র ইতিহাস

তৎকালীন প্রখ্যাত স্থপতি ওয়াল্টার গ্রান্টের তত্ত্বাবধানে আদালত ভবনটি তৈরি হয়। এই বিল্ডিংটি দেখতে ইউরোপের কোনো ঐতিহাসিক ভবনের মতোই মনে হয়। আদালতের প্রধান ভবনটি ফ্রেডেরিক উইলিয়াম স্টিভেন্সের নকশা অনুসারে তৈরি হয়েছিল, যা কলকাতার স্থাপত্যে নতুন মাত্রা যোগ করে। এত পুরোনো ভবন এখনও কৌতুহল জাগায়।

স্বাধীনতা আন্দোলন ও হাইকোর্টের ভূমিকা

ব্রিটিশ শাসনকালে কলকাতা হাইকোর্ট একাধিক যুগান্তকারী মামলার রায় দিয়েছে, যা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করেছে। বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত অনেক নেতার বিচার এই আদালতেই হয়েছিল।

যেমন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, বীরেন্দ্রনাথ শাসমল, শরৎ চন্দ্র বসু প্রমুখ এই আদালতে লড়াই করেছেন। ১৯০৮ সালের আলিপুর বোমা মামলাটি এই হাইকোর্টের ইতিহাসে অন্যতম আলোচিত মামলা। সেই মামলার রায় ও যুক্তিতর্ক স্বাধীনতা আন্দোলনে নতুন উদ্দীপনা এনে দেয়।

বাঘের আস্তানা থেকে কলকাতা স্টেশন, চিৎপুরের চুপকথা

স্থাপত্যশৈলী ও স্থাপনার বৈশিষ্ট্য

কলকাতা হাইকোর্টের স্থাপত্যশৈলী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মূল ভবনটি পশ্চিম ইউরোপীয় রিভাইভাল স্টাইলে নির্মিত। লাল ইটের গাঁথুনি, সাদামাটা খোদাই, উঁচু টাওয়ার এবং বড় বড় খিলান এই আদালত ভবনকে এক ভিন্ন মর্যাদা দিয়েছে।

অভ্যন্তরীণ স্থাপনাগুলোতেও ব্রিটিশ স্থাপত্যশৈলীর ছাপ স্পষ্ট। বিশাল লাইব্রেরি, বড় বড় আদালত কক্ষ এবং রেফারেন্স রুমগুলো বিচার প্রক্রিয়াকে অনেক সুশৃঙ্খল করেছে। আজও এই ঐতিহ্যবাহী ভবনটি হাজারো মানুষকে ন্যায়ের আশায় আকর্ষণ করে।

বর্তমান কাঠামো ও বিচার প্রক্রিয়া

বর্তমানে কলকাতা হাইকোর্ট পশ্চিমবঙ্গ, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়। এখানে প্রধান বিচারপতিসহ প্রায় ৭২ জন বিচারপতি দায়িত্ব পালন করেন। তবে বিচারপতির শূন্যপদ এবং মামলার জটিলতা আজও বড় চ্যালেঞ্জ।

প্রতিদিন প্রায় হাজারের বেশি মামলা এই হাইকোর্টে তালিকাভুক্ত হয়। বিচারপ্রার্থীদের দীর্ঘ প্রতীক্ষা এবং মামলার জট ছাড়াও কোর্টের পরিকাঠামোতেও আধুনিকীকরণের প্রয়োজন রয়েছে। করোনা মহামারির পর অনলাইন শুনানির প্রক্রিয়া কিছুটা গতি এনেছে। তবে এখনও ই-ফাইলিং, ডিজিটাল কেস ম্যানেজমেন্ট সম্পূর্ণভাবে রূপায়ণ হয়নি।

রাধাকান্ত হয়েছিল শশীকান্ত, চিনে নিন বাঙালির হারিয়ে যাওয়া তবলিয়াকে

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও চ্যালেঞ্জ

কলকাতা হাইকোর্টের সামনে এখনো বেশ কিছু বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। মামলার জট কমানো, বিচার প্রক্রিয়াকে আরও জনবান্ধব করা এবং আধুনিক প্রযুক্তিকে পুরোপুরি ব্যবহার করা অত্যন্ত জরুরি।

সরকার ও আদালত যৌথভাবে আদালতের পরিকাঠামো উন্নয়নের উদ্যোগ নিচ্ছে। নতুন ভবন তৈরি, ভার্চুয়াল কোর্ট, ই-লাইব্রেরি চালু করার পরিকল্পনা চলছে। আইনজীবী এবং বিচারক সমাজও চাইছে দ্রুতগামী ও স্বচ্ছ বিচারব্যবস্থা।

কলকাতা হাইকোর্ট শুধুমাত্র একটি আদালত নয়, এটি বাঙালি তথা ভারতের গর্বের প্রতীক। এর ইতিহাস আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে কলকাতা হাইকোর্ট নতুন প্রযুক্তি ও সময়ের চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে চাইছে।

Source: https://www.calcuttahighcourt.gov.in/



Discover more from Unknown Story

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Exit mobile version