কলকাতা শহরে কমতে থাকা বাস ও ব্যক্তিগত গাড়ির দাপট থেকে বাঁচার জন্য শহর ও শহরতলির মানুষের অন্যতম ভরসা মেট্রো। সকাল থেকে শুরু করে রাত পর্যন্ত দৌড়ে বেড়ানো মেট্রোয় অফিস টাইমে পা দেওয়ার সুযোগ থাকে না।
সাশ্রয়ী, পরিবেশবান্ধব, আরামদায় ও দ্রুত গন্তব্যে যাওয়া যায় বলে মেট্রো রেলের চাহিদাও অনেক বেশি। তবে মেট্রো শুধু চড়া নয়। কলকাতায় মেট্রোয় চাপা মানে একটা ইতিহাসের সঙ্গে চলা। যা সাধারণ মানুষকে নস্ট্যালজিক করে তোলে।
কলকাতা মেট্রো: শুরুর কথা
কলকাতার যানজট সমস্যা নতুন কিছু নয়। স্বাধীনতার পর ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা আর সীমিত সড়ক পরিকাঠামো শহরবাসীর ভোগান্তি বাড়াতে থাকে।
এই সমস্যা সমাধানে ১৯২১ সালেই প্রথম মেট্রো প্রকল্পের কথা ভাবা হয়েছিল, তবে তা কার্যকর হয়নি। কলকাতা মেট্রোর ইতিহাস লিখতে গেলে এই অংশটা রাখতেই হবে।
কলকাতা মেট্রো তৈরিতে আসল গতি আসে ১৯৬৯ সালে যখন মেট্রো রেলওয়ে বোর্ড গঠিত হয়। ১৯৭১ সালে ভারতের রেল মন্ত্রক কলকাতায় মেট্রো নির্মাণের ছাড়পত্র দেয়।
এরপর ১৯৭২ সালের ২৯ ডিসেম্বর কলকাতা মেট্রোর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী।
ছিল ইংরেজদের দপ্তর, এখন ডাকঘর, জেনে নিন কলকাতা GPO-র ইতিহাস
ভারতে প্রথম মেট্রো
ভারতের মেট্রো রেল ইতিহাসের শুরু কলকাতা শহর থেকেই। আজকের দিনে ভারতের বহু শহরে মেট্রো পরিষেবা চালু থাকলেও এর পথিকৃৎ কিন্তু কলকাতা।
১৯৮৪ সালে চালু হওয়া কলকাতা মেট্রো শুধু দেশের নয়, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম ভূগর্ভস্থ মেট্রো রেল।
এই যাত্রাপথের ইতিহাস, চ্যালেঞ্জ, সম্প্রসারণ, বর্তমান পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা – সবই আজকের এই গল্পে।
বাঘের আস্তানা থেকে কলকাতা স্টেশন, চিৎপুরের চুপকথা
নির্মাণের চ্যালেঞ্জ: টানেল খোঁড়া থেকে প্রযুক্তি
মাটির তলা দিয়ে যে ট্রেন চলতে পারে সেটা প্রথম কলকাতাতেই প্রমাণ হয়। কোনও কাজ প্রথম করাটা চ্যালেঞ্জের।
তাই কলকাতায় মাটির নিচে টানেল খোঁড়া মোটেও সহজ কাজ ছিল না। শহরের পুরনো বাড়ি, সরু রাস্তা আর নরম মাটি ইঞ্জিনিয়রদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।
বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় Cut and Cover পদ্ধতি এবং Shield Tunnelling পদ্ধতি ব্যবহার করে কাজ এগোয়।
বিশ্বব্যাংক এবং জার্মানির প্রযুক্তিগত সহায়তা এই প্রকল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ১৯৮৪ সালের ২৪ অক্টোবর প্রিন্সেপ ঘাট থেকে এসপ্ল্যানেড পর্যন্ত ৩.৪ কিমি রুটে ভারতের প্রথম মেট্রো চলাচল শুরু হয়।
রাধাকান্ত হয়েছিল শশীকান্ত, চিনে নিন বাঙালির হারিয়ে যাওয়া তবলিয়াকে
কলকাতা মেট্রোয় প্রথম যাত্রার স্মৃতি
কলকাতা মেট্রোর প্রথম দফায় ছিল মাত্র ৩টি স্টেশন – এসপ্ল্যানেড, পার্কস্ট্রিট এবং ভবানীপুর (বর্তমানে যেটি নেতাজী ভবন বলে পরিচিত)।
প্রথম মেট্রো চলেছিল মোট ১০০ জন বিশেষ অতিথি নিয়ে। শহরের মানুষ সেই দিনের ঐতিহাসিক মুহূর্ত আজও মনে রেখেছেন।
প্রথম দফার সাফল্যের পর ধাপে ধাপে রুট সম্প্রসারিত হয়। ১৯৯৫ সালে দমদম থেকে টালিগঞ্জ পর্যন্ত লাইন চালু হয়, যা এখন উত্তর-দক্ষিণ করিডোর নামে পরিচিত।
বর্তমানে কলকাতা মেট্রো রেলওয়ে একাধিক লাইনে সম্প্রসারিত হচ্ছে।
বর্তমান কলকাতা মেট্রো: কতদূর এগিয়েছে
বর্তমানে কলকাতায় মেট্রো রেলের মোট ৬টি রুট (Line 1 থেকে Line 6) পরিকল্পনায় রয়েছে, যার মধ্যে বেশ কিছু অংশ ইতিমধ্যেই চালু।
উত্তর-দক্ষিণ লাইনটি এখন নোয়াপাড়া থেকে কবি সুভাষ পর্যন্ত বিস্তৃত, দৈর্ঘ্য প্রায় ৩১ কিমি।
সম্প্রতি চালু হয়েছে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো (Line 2), যা সল্টলেক থেকে হাওড়া ময়দান পর্যন্ত যাবে।
এই লাইন ভারতের প্রথম আন্ডার-রিভার টানেল হিসেবে বিশেষ স্বীকৃতি পেয়েছে।
গঙ্গা নদীর নিচ দিয়ে প্রায় ৫০০ মিটার লম্বা টানেল আন্তর্জাতিক স্তরের প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি হয়েছে।
মাটির তলায় প্রথম মেট্রো থেকে শুরু করে নদীর তলায় প্রথম মেট্রো চালিয়েও নজির তৈরি করল কলকাতা।
দিল্লিতে নয়, কলকাতাতে ছিল সুপ্রিম কোর্ট, জানেন কোথায়?
যাত্রীসেবার মান ও সুবিধা
কলকাতা মেট্রো তার যাত্রীদের জন্য উন্নত মানের পরিষেবা দেওয়ার চেষ্টা করে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কোচ, স্মার্ট কার্ড, রিচার্জেবল টোকেন, মহিলা ও সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা – সবই যাত্রীদের সুবিধার্থে।
তবে কলকাতা মেট্রোর মূল সমস্যা ট্রেনের ফ্রিকোয়েন্সি এবং পিক আওয়ারে ভিড় সামাল দেওয়া। প্রায় ৭ লাখ যাত্রী প্রতিদিন মেট্রো ব্যবহার করেন। অনেক স্টেশনে লিফট, এসকেলেটর ও ডিজিটাল ডিসপ্লে সিস্টেমও চালু হয়েছে।
তাছাড়া ইস্ট-ওয়েস্ট করিডোরে আধুনিক সিগন্যালিং ও CBTC সিস্টেম (Communication-Based Train Control) ব্যবহার করা হচ্ছে।
সম্প্রসারণ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
কলকাতা মেট্রো সম্প্রসারণ নিয়ে রেলওয়ে ভবিষ্যতে শহর ও শহরতলি জুড়ে মেট্রো নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করার পরিকল্পনা নিয়েছে। নতুন লাইনগুলির মধ্যে রয়েছে:
লাইন ২ (ইস্ট-ওয়েস্ট): হাওড়া ময়দান থেকে সেক্টর ফাইভ পর্যন্ত। নদীর তলা দিয়ে সংযোগ।
(জোকা-বিবাদী বাগ) লাইন ৩: দক্ষিণ কলকাতার জোকা থেকে বিবাদী বাগ পর্যন্ত সংযোগ।
লাইন ৪ (নোয়াপাড়া-বড় বাজার): নতুন বাণিজ্যিক এলাকা যুক্ত করবে।
লাইনে ৫ ও ৬: বারাসত, নিউ গড়িয়া, এয়ারপোর্টের সঙ্গে শহরকে আরও ভালোভাবে যুক্ত করবে।
এই সম্প্রসারণ শেষ হলে কলকাতায় প্রায় ১০০ কিমি মেট্রো নেটওয়ার্ক হবে, যা শহরের পরিবহন ব্যবস্থা আমূল পরিবর্তন করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
অন্যান্য মেট্রো বনাম কলকাতা মেট্রো
কলকাতা মেট্রো ভারতের সবচেয়ে পুরনো মেট্রো হলেও এখন দেশের নানা শহরে অত্যাধুনিক মেট্রো রেল চালু হয়েছে – দিল্লি, বেঙ্গালুরু, মুম্বই, হায়দরাবাদ, চেন্নাই প্রভৃতি।
কলকাতার তুলনায় এই শহরগুলোর মেট্রো অনেক বেশি প্রযুক্তি-নির্ভর, দ্রুত সম্প্রসারিত ও যাত্রীবান্ধব।
ভাড়া কত কলকাতা মেট্রোর?
কলকাতা মেট্রোয় নূন্যতম ভাড়া ৫ টাকা ও সর্বোচ্চ ৩৫ টাকা। ভবিষ্যতে এটা আরও বাড়তে পারে।
কলকাতা মেট্রোর ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ
বর্তমানে কলকাতা মেট্রোর অবস্থার কথা বলতে গেলে কলকাতা মেট্রোর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো সময়মতো নির্মাণ শেষ করা ও ব্যয় নিয়ন্ত্রণে রাখা।
রাজনৈতিক জটিলতা, জমি অধিগ্রহণ সমস্যা, পুরনো শহরের গলিপথের কারণে কাজ প্রায়ই বিলম্বিত হয়।
তাছাড়া যাত্রীদের নিরাপত্তা, আধুনিক রক্ষণাবেক্ষণ, জরুরি অবস্থার ব্যবস্থা আরও জোরদার করতে হবে।
নদীর তলা দিয়ে মেট্রো চালানো যেমন গর্বের, তেমনি এটি রক্ষণাবেক্ষণের দিক থেকেও বড় দায়িত্ব।
কলকাতা মেট্রো শুধুমাত্র ভারতের প্রথম মেট্রো নয়, এটি শহরবাসীর আবেগের সাথে জড়িয়ে আছে।
বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে কলকাতা মেট্রো আজ দেশের গর্ব।
যতই নতুন শহরে মেট্রো আসুক, কলকাতা মেট্রো তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও পুরনো বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে আজও অনন্য।
Discover more from Unknown Story
Subscribe to get the latest posts sent to your email.
Leave a Reply