ইতিহাসের কলকাতায় ছড়িয়ে ভূতের বাড়ি, জানেন ইতিহাস?


বাঙালির জীবনে একটা বড় অংশজুড়ে রয়েছে ভূত। সে শৈশবে ‘ভূত আমার পুত, পেত্নী আমার ঝি’ ছড়া বলে ভয় তাড়ানো হোক বা বড় হয়ে একাধিক ভূতের গল্প হোক।

এই একটা বিষয় যেন বাঙালি কিছুতেই সঙ্গ ছাড়া করতে পারছে না। বাঙালির জীবনে যেখানে ভূত আছে, সেখানে কলকাতায় ভূত থাকবে না তা কি হয়?

এই শহরের অলিগলি, প্রাসাদ আর রাজবাড়িগুলোয় গা ছমছমে গল্পের শেষ নেই। পুরনো কলকাতার মানুষজন যেমন এই গল্পগুলোকে বিশ্বাস করেন, তেমনি ভয় আর কৌতূহলের জন্য আজও এখানে ভিড় জমে।

জেনে নিন “কলকাতার ভূতের বাড়ি” কিছু কথা। কোথায় আছে, কী ভাবে যাবেন, ইতিহাস, আর কেনই বা একে ভূতের বাড়ি বলা হয়।

কোন বাড়ি বা জায়গাগুলো কলকাতার ভূতের বাড়ি নামে পরিচিত?

কলকাতায় এক নয়, একাধিক বাড়ি, প্রাসাদ আর পুরনো জমিদার বাড়ি আছে যেগুলোর নাম ‘ভূতের বাড়ি’। এই নামটা মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে গিয়েছে। যেগুলো হলো-

ন্যাশনাল লাইব্রেরি (National Library)

লোকেশন: বেলভেডিয়ার রোড, আলিপুর, কলকাতা – ৭০০০২৭
গুগল ম্যাপের লিঙ্ক

ন্যাশনাল লাইব্রেরিকে কেন ভূতের বাড়ি বলা হয়?

ব্রিটিশ আমলে বেলভেডিয়ার এস্টেট ছিল গভর্নর জেনারেলের সরকারী বাসভবন।

শোনা যায় গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংসের স্ত্রীর মৃত্যু হয় এই বাড়িতেই।

এখনো গভীর রাতে লাইব্রেরির লম্বা করিডোরে সাদা শাড়ি পরা মহিলাকে দেখা যায়, গার্ডদের অভিজ্ঞতায় নাকি ফাইল সরানো, পায়ের শব্দ, হাওয়ার শোঁ শোঁ আওয়াজ শোনা যায়।

ন্যাশনাল লাইব্রেরি (সৌজন্যে সোশ্যাল মিডিয়া)

ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে যাওয়া অনেকের দাবি, লাইব্রেরির একটা অংশ নাকি বাকি অংশের থেকে ঠাণ্ডা। ফাঁকা ঘরেও নাকি পায়ের আওয়াজ শোনা যায়।

হেস্টিংস হাউস (Hastings House)

লোকেশন: ২০ বি, Judges Court Road, Alipore, Kolkata – Presidency University-র কাছে

গুগল ম্যাপের লিঙ্ক

হেস্টিংস হাউসকে কেন ভূতের বাড়ি বলা হয়?

এটি ওয়ারেন হেস্টিংসের আরেকটি প্রাসাদ। একাধিক রিপোর্ট মতে, ওয়ারেন হেস্টিংস নাকি তাঁর হারানো দলিল খুঁজতে এখনও ঘোড়ার গাড়িতে রাতের অন্ধকারে ঘুরে বেড়ান।

পুতুলবাড়ি (Putulbari – The House of Dolls)

লোকেশন: Ahiritola, Sovabazar, Kolkata – ৭০০০০৫

গুগল ম্যাপের লিঙ্ক

পুতুলবাড়িকে কেন ভূতের বাড়ি বলা হয়?

শোভাবাজারের এই বাড়িটিকে বলা হয় কলকাতার আসল ভূতের বাড়ি। বিশাল কাঠের দরজা, পুরনো লোহার সিঁড়ি, ছাদে শতাধিক পুরনো পুতুল।

পুতুল বাড়ি (সৌজন্যে সোশ্য়াল মিডিয়া)

জমিদার পরিবার, নাচনবাই আর অত্যাচারের গল্পে ভরা এই প্রাসাদে আজও নাকি রাতের বেলা কান্নার আওয়াজ পাওয়া যায়।

কলকাতার চর্চিত ভূতের বাড়িগুলোতে কী ভাবে যাবেন?

ন্যাশনাল লাইব্রেরি

  • মেট্রো: Jatin Das Park / Rabindra Sadan থেকে ট্যাক্সি বা অটোতে সহজেই যাওয়া যায়।
  • বাস: Alipore বা Belvedere Road ধরে বেশ কিছু সরকারি ও বেসরকারি বাস চলাচল করে।

হেস্টিংস হাউস

  • নিকটতম মেট্রো: Netaji Bhavan বা Kalighat মেট্রো থেকে অটো বা ক্যাব।
  • বাস: Judges Court Road ধরে সরাসরি গাড়ি চলে।

পুতুলবাড়ি

  • নিকটতম রেল স্টেশন: শোভাবাজার লঞ্চ ঘাট থেকে ৫ মিনিট হাঁটলেই Ahiritola ঘাট।
  • বাস: শোভাবাজার স্ট্রিট ধরে শিয়ালদহ বা কলকাতা স্টেশন থেকে অটো বা ট্যাক্সি পাওয়া যায়।

কী করে এগুলোর নাম ভূতের বাড়ি হলো? জেনে নিন সেই গল্প

ন্যাশনাল লাইব্রেরি

ব্রিটিশ যুগে বেলভেডিয়ার হাউস ছিল গভর্নর জেনারেলের সরকারি বাসভবন। কথিত আছে, গভর্নর হেস্টিংসের স্ত্রী লেডি অ্যান হেস্টিংসকে একদিন মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।

সুস্থ মানুষের এই আকষ্মিক মৃত্যু খটকা দিয়েছিল সবাইকে। অনেক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, সেই মৃত্যুরহস্য আজও অমীমাংসিত। সেই কারণে গভীর রাতে নাকি লাইব্রেরির পুরনো অংশে তাঁর আত্মা সাদা শাড়ি পরে ঘোরেন।

হেস্টিংস হাউস: হারানো দলিলের খোঁজে

ওয়ারেন হেস্টিংস কলকাতার গভর্নর জেনারেল থাকাকালে বহু রাজনৈতিক চক্রান্তের শিকার হন।

শোনা যায়, তাঁর জীবনে সবচেয়ে বড় ধাক্কা ছিল একটি দলিল হারিয়ে ফেলা। সেই দলিলটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

সেই সেটা খুঁজতে তাঁর জীবনের একটা বড় সময় যায়। তিনি সেই দলিলটি এখনও খুঁজছেন বলে দাবি। সেই কারণে তিনি প্রাসাদের করিডোরে ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে ঘোরেন।

পুতুলবাড়ি: ভূতের পুতুল?

পুতুলবাড়ি একসময় ছিল জমিদারদের প্রাসাদ। উপরের তলায় নাচনবাইদের জন্য বিশেষ ঘর থাকত।

জমিদারদের আমোদের একটা প্রধান মাধ্যম ছিলেন সেই নর্তকীরা। শোনা যায়, জমিদারদের অত্যাচারে অনেকেই আত্মহত্যা করেছিলেন।

সেই বাড়ির ছাদে এখনো শতাধিক পুরনো পুতুল সাজানো। লোকেদের দাবি, এই পুতুলগুলো নাকি রাতে বেঁচে ওঠে! সেগুলো নাকি মৃত মানুষদের পুতুল।

ভূতের ভয় নেই? তা হলে একবার যান!

বেশ কিছু ভ্রমণপিপাসু আর Ghost Hunter গোষ্ঠী মাঝেমধ্যে রাতে এই জায়গাগুলোতে গিয়ে Paranormal Activity রেকর্ড করার চেষ্টা করেন।

কেউ ক্যামেরায় অদ্ভুত আলো বা ছায়া পেয়েছেন বলেও দাবি করেছেন। তবে সরকারিভাবে রাতে ঢোকা প্রায় সব জায়গাতেই নিষিদ্ধ।

কলকাতার ভূতের বাড়ি গুলো শুধু ভয়ের জায়গা নয় — এগুলো ইতিহাসেরও জীবন্ত সাক্ষী।

গভর্নর হেস্টিংসের রাজনীতি, জমিদারদের অত্যাচার আর সেসবের ছায়া আজও এই শহরের গলিতে লুকিয়ে আছে। হয়তো ভূত নেই, হয়তো কিছুই নেই।

তথ্যসূত্র:

The Telegraph India – ‘Haunted Kolkata: A Walk Through History’
Times of India Travel – ‘Most Haunted Places in Kolkata’
‘Ghosts of Kolkata’ – সৌগত চট্টোপাধ্যায়
Paranormal Society of Kolkata
BBC Bengali – Kolkata’s Ghost Stories

ডিসক্লেইমার

এই লেখাটি সম্পূর্ণরূপে গবেষণা, লোককথা, বিভিন্ন উৎস ও মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত কিংবদন্তির উপর ভিত্তি করে লেখা। এখানে বর্ণিত কোনও ভৌতিক ঘটনা, আত্মার অস্তিত্ব বা অশরীরী কার্যকলাপের বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। এই বিষয়বস্তুটি শুধুমাত্র পাঠকদের কৌতূহল, স্থানীয় ইতিহাস ও ফোকলোরের প্রতি আগ্রহ বাড়ানোর জন্যই প্রকাশিত হয়েছে।

পাঠকগণের প্রতি অনুরোধ, কেউ ভয় পেয়ে বা প্রলুব্ধ হয়ে অনুমতি ছাড়া কোনো বেসরকারি বা সংরক্ষিত স্থানে প্রবেশ করবেন না। এই লেখার দায়-দায়িত্ব লেখক বা প্রকাশকের নয়।



Discover more from Unknown Story

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Exit mobile version