রাধাকান্ত হয়েছিল শশীকান্ত, চিনে নিন বাঙালির হারিয়ে যাওয়া তবলিয়াকে

radhakanta nandi

সমৃদ্ধ নষ্কর

“কাহারবা নয় দাদরা বাজাও, উল্টোপাল্টা মারছো চাঁটি/ রাধাকান্ত তুমি দেখছি আসরটাকে করবে মাটি” 

হ্যাঁ ঠিকই শুনেছেন! শশীকান্ত নয় ওটা রাধাকান্ত! সন্ন‍্যাসী রাজা ছবির জন্য গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার যখন লিখেছিলেন ‘কাহারবা নয় দাদরা বাজাও, উল্টোপাল্টা মারছো চাঁটি/ রাধাকান্ত তুমি দেখছি আসরটাকে করবে মাটি’ তখন সেই গানে মান্না দে-র সঙ্গে তবলা বাজাতে চাননি স্বয়ং পন্ডিত রাধাকান্ত নন্দী ওরফে তবলার জাদুকর রাধাকান্ত নন্দী। তালের জাদুকর কখনও উল্টোপাল্টা তবলা বাজান না। সেহেতু প্রবাদ প্রতিম গীতিকার শ্রী গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার যিনি কি না তাঁর লেখনীর জাদুতে আপামর বাঙালির বুকে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন তাকে শেষমেশ ‘রাধাকান্ত’ নামের জায়গায় লিখতে হল ‘শশীকান্ত’। এমনই আপোষহীন তবলাশিল্পী ছিলেন শ্রী রাধাকান্ত নন্দী। 

কে রাধাকান্ত নন্দী?

রাধাকান্ত নন্দীর পরিচয় আমরা কতজন বাঙালি মনে রাখি? রাখবার কথাও হয়তো নয়, কারণ উনি হলেন সেই দানবীর কর্ণের মতো যার এক হাত থেকে দান করলে অন্য হাত টের পেতো না। উনি রঙ্গমঞ্চের আড়ালের অতিমানব, একজন নাম না জানা শিল্পী। কত হিট বাংলা আধুনিক ও ছায়াছবির গানে তাঁর তবলা বিস্ময়ের চূড়া ছুঁয়েছে। তাঁর কথায় ‘তবলা আমায় বাজায়,তাইতো আমি বাজি/তবলাকে মোর দুঃখ দিয়ে বাজাতে নই রাজি’— এমন ছন্দময় রসিক মানুষের কাছে এমন তালময় কথাই তো আমাদের বাড়তি পাওনা।

তিনি জন্মেছিলেন ২৩ মে অধুনা বাংলাদেশের বরিশাল জেলার বানরি পাড়া গ্রামে।

বাড়িতেই সঙ্গীতের হাতেখড়ি

সঙ্গীত যে তাঁর রক্তে ছিল সেটা তার পূর্বপুরুষের পরিচয় থেকেই জানা যায়। ঠাকুরদা শ্রী কালীচরণ নন্দীর উৎসাহে নগর পরিক্রমায় নগরকীর্তনের দলে শিশু রাধাকান্তকেও দেখা যেত শ্রীখোল হাতে। শ্রীখোল বাজাতে বাজাতে একদিন এভাবেই ঝোঁক এল তবলায়। হয়তো একেই বলে ‘ঠিক তালে আছে’। সমস্ত বাঙালি বাবার মতো রক্তচক্ষু শাসন, পড়াশোনার চাপও তাঁর তবলা সাধনার ইচ্ছা দমাতে পারেনি। তিনি নাকি সেই সময় পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিলেন। 

WhatsApp Image 2025 06 15 at 12.05.51 PM

রাধাকান্ত নন্দী

মার্গসঙ্গীতে সঙ্গত করছেন বাবা আলাউদ্দিন খাঁ (যিনি ভারতরত্ন শ্রী পন্ডিত রবিশঙ্করের মতো দিকপাল সঙ্গীতজ্ঞের সৃষ্টি করেছিলেন), আমির খাঁ, নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাপদ চক্রবর্তী, মণিলাল নাগ প্রমুখ ওস্তাদ ও পণ্ডিতের সঙ্গে। নেপথ্য সংগীতে ওস্তাদ আলি আকবর খাঁর (উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের সুযোগ্য পুত্র) সঙ্গে সঙ্গত করেছেন। সব ধরনের তালবাদ্যর বিষয়ে ছিল তাঁর অগাধ জ্ঞান।

যখন তিনি সঙ্গীত মহলে প্রসংশার ঊর্ধ্বে তখন এমন কোনো দিন ছিল না যে রাধাকান্তর রেকর্ডিং থাকত না। এলপি রেকর্ড সঙ্গীত জগতে প্রশংসিত তাঁর হাতে বাজানো দশটি যন্ত্র।

তবে সমস্ত পন্ডিত বা ওস্তাদের একজন গুরু থাকেন, তিনি  ওস্তাদ আনখেলাল এর কাছে তালিম নিয়ে পরিপক্ক তবলা বাদকে পরিণত হয়েছিলেন। মুম্বই থেকে কোন আর্টিস্ট কলকাতায় শো করতে আসলে সবার প্রথম তবলা বাদক হিসেবে রাধাকান্ত নন্দীর নামটাই আগে উচ্চারিত হতো। সেটা লতা মঙ্গেশকর হোক বা আর ডি বর্মন। উঁচুতে উঠতে গেলে সিঁড়ি লাগে, যদিও ওঠার পর সেই সিঁড়িকে কেউ মনে রাখে না,  রাধাকান্ত নন্দী হলেন সেই সিঁড়ি। সঙ্গীত জগতের মানুষদেরকে উপরে তুলে তিনি আড়ালে রয়ে গেলেন। 

আধুনিক বাংলা গানে মান্না দের গানের সঙ্গে রাধাকান্ত নন্দীর তবলা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। মান্না দে ছাড়াও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র প্রমুখ প্রখ্যাত গায়ক-গায়িকাদের সঙ্গেও তিনি সঙ্গত করে গিয়েছেন। নজরুল গীতিতে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গেও তাঁর তবলাবাদন বিশেষ উল্লেখযোগ্য।



Discover more from Unknown Story

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

2 comments

Leave a Reply