২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে পূর্ণাঙ্গ আক্রমণের ঘোষণা করে রাশিয়া। ধারে-ভারে ও আকারে ইউক্রেনের থেকে রাশিয়া অনেক বড়। আর্থিক ক্ষমতা রাশিয়ার অনেক বেশি। কিন্তু তা সত্বেও ২০২৫ সালের শেষের দিকে এসেও ইউক্রেন দখল করতে পারেনি রাশিয়া। বরং একাধিকবার রাশিয়া ব্যাকফুটে চলে গিয়েছে। তবে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ (Russia Ukrain War) প্রভাব ফেলেছে বিশ্ব অর্থনীতিতে, বদলে দিয়েছে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সমীকরণ এবং জন্ম দিয়েছে এক নতুন ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট।
Table of Contents
রাশিয়া ও ইউক্রেনের সম্পর্কের ইতিহাস
রাশিয়া এবং ইউক্রেন দুটোই প্রতিবেশি দেশ। আর ইতিহাস সাক্ষী আছে প্রতিবেশি দেশ অধিকাংশ সময়ে ভালো হয় না। এই দুই দেশের ইতিহাস হাজার বছরের পুরোনো। দুই দেশই স্লাভিক জাতির অন্তর্ভুক্ত এবং একটা সময়ে কিভান রুশ নামক একটি শক্তিশালী রাজ্যের অংশ ছিল। ফলে বর্তমানে দুই দেশ একটা সময়ে একসঙ্গে ছিল। এর পর দুই দেশই সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ হয়। সেখানে ইউক্রেন ছিল অন্যতম সফল দেশ। কারণ এই দেশ কৃষি, প্রযুক্তিতে ছিল উন্নত।
African tribe in India: দেশের মধ্যে এক টুকরো আফ্রিকা, চিনে নিন গুজরাটের জাম্বুর গ্রামকে
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ইউক্রেন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তবে ইউক্রেনের এই স্বাধীনতা মেনে নিতে পারেনি রাশিয়া। তবে শুরুতে সম্পর্ক ভালোই ছিল। ইউক্রেন ১৯৯৪ সালে তাদের পারমাণবিক অস্ত্রাগার ছাড়তে সম্মত হয়ে চুক্তি করে রাশিয়ার সঙ্গে। সেখানে আমেরিকা, ব্রিটেনের মতো দেশগুলোও ছিল।
কিন্তু সময় যত এগোতে থাকে, ততই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। ইউক্রেনের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় ইউরোপীয় ইউনিয়নে প্রবেশ করা, যাতে NATO-র থেকে সাহায্য মেলে। ইউক্রেনের এই চাহিদা রাশিয়া ভালোভাবে নেয়নি। রাশিয়া মনে করেছে, ইউক্রেনের ক্ষমতা বাড়লে সেটা তাদের জন্য খারাপ হবে। তাই রাশিয়া বারবার বাধা দিয়েছে ইউক্রেনকে। এই পরিস্থিতি খারাপ হয় ২০১৪ সালে। ইউক্রেনে রুশ বিরোধী সরকার আসার পর রাশিয়া ইউক্রেনের ক্রিমিয়া দখল করে এবং ধীরে ধীরে ইউক্রেনে রুশ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সক্রিয় করে।
রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ: আর্থিক ক্ষমতা ও সামরিক শক্তি
সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে রাশিয়া ইউক্রেনের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী। রাশিয়া বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ পারমাণবিক শক্তিধর দেশ এবং তার সামরিক বাজেট ইউক্রেনের তুলনায় অনেক বেশি।
রাশিয়ার আয়ের অন্যতম উৎস হচ্ছে তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস। মধ্যপ্রাচ্যের পর রাশিয়ায় সবচেয়ে বেশি তেল পাওয়া যায়। এটাই রাশিয়াকে এগিয়ে রাখে। তবে তারা ইউক্রেনে আক্রমণের পর বিশ্বে একাধিক মহল থেকে নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়ে। ইউরোপের দেশগুলো রাশিয়ার থেকে তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস নিতে অস্বীকার করে এবং একাধিক রুশ ব্যবসায়ীকে ইউরোপে ব্যবসা করতে বাধা দেয়।
শুরুতে রাশিয়া ধাক্কা খেলেও, তাদের প্রাকৃতিক সম্পদ এতটাই ছিল যে সেটা কোনও সমস্যার কারণই হয়নি। বরং যুদ্ধ অর্থনীতি রাশিয়াকে আরও শক্তিশালী করে তোলে। যুদ্ধ থেকে রাশিয়ায় চাকরি বাড়ে। রাশিয়া যুদ্ধাস্ত্র বিক্রি করে আয় করতে থাকে এবং সেই টাকা দিয়ে তারা যুদ্ধ করে।
অন্যদিকে ইউক্রেনের আয়ের প্রধান উৎস কৃষিকাজ। সেখানে তারা ধাক্কা খায়। তাদের GDP ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে, একের পর এক শহর ধ্বংস হয়েছে এবং বহু মানুষ কর্মসংস্থান হারিয়েছেন। যদিও রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়তে ইউক্রেনের অন্যতম ভরসা ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আমেরিকার থেকে পাওয়া সাহায্য। সেটা যতদিন থাকবে ততদিন লড়তে পারবে ইউক্রেন।
রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে আমেরিকা ও অন্য দেশগুলির ভূমিকা (Russia Ukrain War)
দুই দেশের লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয় তৃতীয় পক্ষ। রাশিয়া ইউক্রেনের লড়াইয়ে বারবার মাথা ঘামিয়েছে আমেরিকা। কারণ বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে আমেরিকা, রাশিয়া রয়েছে একই সারিতে।
রাশিয়া যখন ইউক্রেন আক্রমণ করে, তখন পশ্চিমা বিশ্ব এর তীব্র নিন্দা জানায় এবং রাশিয়ার উপর কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এই নিষেধাজ্ঞার উদ্দেশ্য ছিল রাশিয়ার অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিয়ে যুদ্ধ বন্ধে চাপ সৃষ্টি করা। পাশাপাশি, ন্যাটো জোট ইউক্রেনকে সামরিক, আর্থিক এবং মানবিক সহায়তা প্রদান করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে সামরিক সরঞ্জাম, যেমন- উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা, ট্যাঙ্ক এবং ড্রোন সরবরাহ করে, যা ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করে।
ভারতের অবস্থান এবং কৌশল
এই দুই দেশের লড়াইয়ে ভারতের অবস্থান ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কারণ অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত রাশিয়া ভারতের মিত্র রাষ্ট্র। তেল থেকে অস্ত্র ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। আর ভারত সবসময় নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছে যুদ্ধের ক্ষেত্রে। তাই প্রকাশ্যে ভারত রাশিয়া বা ইউক্রেনের পক্ষ নেয়নি। কিন্তু রাশিয়ার থেকে তেল এবং অস্ত্র কেনা চালিয়ে গিয়েছে।
Pakistan Village in Bihar: ভারতের মধ্যে রয়েছে এক টুকরো পাকিস্তান, জানুন ইতিহাস
কেন রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধতে ভারত কোনও পক্ষ নেয়নি?
রাশিয়া ভারতের দীর্ঘদিনের কৌশলগত মিত্র। প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম থেকে শুরু করে জ্বালানি সরবরাহ পর্যন্ত অনেক ক্ষেত্রে ভারত রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল। রাশিয়ার সঙ্গে এই সম্পর্ক নষ্ট করা ভারতের জন্য কঠিন। যদি নষ্ট করে সেক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যের উপর পুরোপুরি নির্ভর করতে হবে, যেটা আর্থিক দিক থেকে খারাপ।
ভারতের অন্য বন্ধু রাষ্ট্র আমেরিকা। পাশাপাশি ইউরোপের সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক রাখতে চায়। ফলে যুদ্ধ নিয়ে কোনও পক্ষের হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। তাই প্রকাশ্যে যুদ্ধের বিরোধীতা করলেও জাতিসংঘের বিভিন্ন ভোটে বিরত থাকে ভারত।
ভারতের এই অবস্থানের নেপথ্যে রয়েছে আর্থিক সুবিধা। কারণ ইউরোপ ও আমেরিকা রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা চাপানোয় রাশিয়া এখন কম দামে তেল বিক্রি করছে। আর ভারত এটার সুবিধা নিয়ে সস্তায় তেল কিনছে রাশিয়ার থেকে। এই কারণে, কিছু পশ্চিমা দেশ ভারতের সমালোচনা করলেও, ভারত তার নিজস্ব অর্থনৈতিক স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়েছে।
রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে অর্থনৈতিক ধাক্কা
এই যুদ্ধের (Russia Ukrain War) ফলে বিশ্বের অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা লেগেছে। খাদ্যদ্রব্যের দাম বেড়েছে, পাশাপাশি প্রাকৃতিক গ্যাসও ধাক্কা খেয়েছে। রাশিয়া এবং ইউক্রেন দুই দেশই গম রপ্তানিকারী অন্যতম দেশ। তাই এই যুদ্ধের ফলে সাপ্লাই লাইন ধাক্কা খেয়েছে।
কী হবে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের ভবিষ্যৎ?
বর্তমানে এই দুই দেশের মধ্যে লড়াইয়ের ফয়সালা হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। দুই পক্ষই তাদের অবস্থানে অনড় এবং সমঝোতায় যেতে চাইছে না। একাধিকবার যুদ্ধবিরতি নিয়ে চুক্তি হলেও সেটা রাশিয়া দ্রুত ভেঙে দিয়েছে। তবে এই যুদ্ধে ইউক্রেনের পাল্টা লড়াইয়ের থেকে রাশিয়া একটা শিক্ষা পেয়েছে। ক্ষমতা ও আয়তনে ছোট হলেই তাদের খাটো করে দেখা উচিত নয়।
FAQ
রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের মূল কারণ কী?
এই সংঘাতের শিকড় অনেক গভীরে, যা সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ হিসেবে দুই দেশের দীর্ঘ ইতিহাস থেকে শুরু হয়। ১৯৯১ সালে ইউক্রেনের স্বাধীনতার পর উত্তেজনা বাড়তে থাকে, যখন ইউক্রেন পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করতে এবং ন্যাটোতে যোগদানের আগ্রহ দেখায়। ২০১৪ সালে সংঘাত তীব্র হয় যখন রাশিয়া ক্রেমিয়া দখল করে এবং পূর্ব ইউক্রেনে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন দেয়। পূর্ণাঙ্গ আক্রমণ শুরু হয় ২০২২ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি।
রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের বর্তমান পরিস্থিতি কী?
যুদ্ধ এখনও চলছে এবং লড়াই মূলত পূর্ব ও দক্ষিণ ইউক্রেনে কেন্দ্রীভূত। রাশিয়া এই অঞ্চলগুলোর বেশিরভাগ অংশ দখল করে আছে, তবে ইউক্রেন তাদের ভূমি পুনরুদ্ধারের জন্য পাল্টা আক্রমণ চালাচ্ছে। এই যুদ্ধের ফলে ভয়াবহ মানবিক সংকট, অবকাঠামোর ব্যাপক ধ্বংস এবং উভয় পক্ষেই অসংখ্য হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।
এই যুদ্ধে ভারতের অবস্থান কী?
ভারত একটি নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রেখেছে এবং রাশিয়াকে সরাসরি নিন্দা জানানো থেকে বিরত থেকেছে। ভারত সংলাপ ও কূটনীতির মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাধানের আহ্বান জানিয়েছে। ভারতের এই অবস্থানের পেছনে রয়েছে রাশিয়ার সঙ্গে তাদের দীর্ঘদিনের কৌশলগত সম্পর্ক।
Discover more from Unknown Story
Subscribe to get the latest posts sent to your email.
Leave a ReplyCancel reply