ছোট দেশগুলোর ভরসা, যুদ্ধে কী ভাবে গুরুত্ব বাড়ছে ড্রোনের?

ড্রোনযুদ্ধ

বিশ্বে বর্তমানে যুদ্ধ পরিস্থিতি। রাশিয়া-ইউক্রেন, ভারত-পাকিস্তান, ইরান-ইজ়রায়েল, ইজ়রায়েল-গাজ়া। কোনও কোনও যুদ্ধ বারবার খবরের শিরোনামে থাকছে। তবে এই যুদ্ধের বিষয়ে একটা নাম বারবার সামনে আসে। সেটা হচ্ছে ড্রোন। ইরান, পাকিস্তান, ইউক্রেন প্রত্যেকের নামের সঙ্গে জুড়ে যায় ড্রোন শব্দটি।

এই ড্রোনগুলোকে বলে কমব্যাট ড্রোন। ছোট দেশগুলো এই কমব্যাট ড্রোন দিয়ে বাজিমাত করতে চাইছে। কী এই কমব্যাট ড্রোন? কী ভাবে কাজ করে? unknownstory.in-এর প্রতিবেদনে জেনে নিন সেটা-

ছোট দেশগুলো কীভাবে কমব্যাট ড্রোন দিয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠছে?

বিশ্ব রাজনীতিতে ছোট দেশগুলোর সামরিক ক্ষমতা নিয়ে অনেকদিন ধরেই প্রশ্ন উঠে আসছে। বড় শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর সামনে এরা প্রায়ই দুর্বল থেকে যায়। কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। কারণ কমব্যাট ড্রোন (Combat Drone) বা ড্রোন যুদ্ধ প্রযুক্তি (Drone Warfare) ছোট দেশগুলোর জন্য বড় গেম-চেঞ্জার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কেন হরমুজ় প্রণালী নিয়ন্ত্রণ করতে চায় ইরান? ভারতের কাছে গুরুত্ব কতটা?

আধুনিক যুদ্ধে ড্রোনের গুরুত্ব

২০ বছর আগেও যুদ্ধক্ষেত্রে ড্রোন শব্দটি ছিল দুর্লভ। এখন যুদ্ধ মানেই ড্রোন স্ট্রাইক। Modern Warfare-এ কমব্যাট ড্রোন এমন এক প্রযুক্তি, যা অনেক কম খরচে এক দেশকে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ক্ষমতা দিতে পারে, পাশাপাশি বিপক্ষকে বিভ্রান্ত করতে এর বিকল্প নেই।

ইরাক যুদ্ধ, আফগানিস্তান বা সিরিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে ড্রোনের ব্যবহার দেখেই বিশ্বের ছোট দেশগুলো শিখেছে — বড় আকারের ট্যাঙ্ক বা ফাইটার জেট না কিনেও Smart Combat Drone দিয়ে শত্রুর উপর আঘাত করা সম্ভব।

ড্রোন কেন ছোট দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ?

ছোট দেশগুলোর সমস্যা হল কম প্রতিরক্ষা বাজেট। বড় দেশগুলোর মতো বিলিয়ন ডলারের যুদ্ধবিমান বা মিসাইল সিস্টেম কেনা সম্ভব নয়। কিন্তু কমব্যাট ড্রোন তুলনামূলকভাবে সস্তা, সহজে মেইনটেইন করা যায় এবং দ্রুত যুদ্ধক্ষেত্রে মোতায়েন করা যায়। এগুলো হাল্কা হওয়ায় চালানোর খরচও কম।

কমব্যাট ড্রোন ব্যবহারের উদাহরণ:

আজ়ারবাইজ়ান: ২০২০ সালে নাগোর্নো-কারাবাখ যুদ্ধে তুরস্কের Bayraktar TB2 Combat Drone ব্যবহার করে আর্মেনিয়ার বড় বড় ট্যাঙ্ক ও আর্মার ধ্বংস করেছে।
ইউক্রেন: রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনও তুরস্কের Bayraktar এবং আমেরিকার Switchblade Drone ব্যবহার করছে।

৩০ বছরের লড়াই, ভিয়েতনাম যুদ্ধের রক্তাক্ত অধ্যায়

সাশ্রয়ী প্রযুক্তি: Bayraktar TB2 এর জয়জয়কার

তুরস্কের Bayraktar TB2 বর্তমানে ছোট দেশের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় Combat Drone। এর দাম একটি যুদ্ধবিমানের তুলনায় ৫০ গুণ কম, অথচ অনেক ক্ষেত্রে একই রকম কাজ করতে পারে।

Bayraktar TB2 ড্রোনের মূল বৈশিষ্ট্য:

  • ২৪ ঘণ্টা টানা উড়তে পারে
  • ১৫০ কিমির পাল্টা, অর্থাৎ, ছাড়ার পর ১৫০ কিলোমিটার উড়তে পারে
  • লেজ়ার-গাইডেড মিসাইল বহন করতে পারে

তুরস্ক এই প্রযুক্তি বিক্রি করছে ইউক্রেন, আজারবাইজান, লিবিয়া, পোল্যান্ডসহ প্রায় ২০টি দেশে।

মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকাতে ড্রোন বিপ্লব

  • মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার একাধিক অঞ্চলে অনেক ছোট দেশ আগে বড় দেশের থেকে দান হিসেবে পাওয়া পুরনো যুদ্ধবিমানেই নির্ভর করত।
  • এতে সমস্যা ছিল অনেক। খারাপ হয়ে যাওয়া, ভেঙে পড়ার মতো ঘটনা ঘটত।
  • এখন এই দেশগুলো নিজেদের Combat Drone প্রোগ্রাম শুরু করেছে।

ইরান: Shahed Drone বানিয়ে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহী, সিরিয়া ও লেবাননে সরবরাহ করছে।
ইথিওপিয়া: দেশের গৃহযুদ্ধে কামিকাজ়ি ড্রোন ব্যবহার করছে।
মরক্কো, নাইজেরিয়া: Bayraktar TB2 ও চিনের Wing Loong II কিনছে।

মারিয়ানা খাত: পৃথিবীর গভীরতম গোপন রহস্য

ড্রোনে চিনের প্রভাব

চিন বিশ্বের অন্যতম বড় কমব্যাট ড্রোন রপ্তানিকারক। তারা Wing Loong সিরিজ ও CH-4 Combat Drone তৈরি করছে, যা Middle East, আফ্রিকার অনেক ছোট দেশের কাছে জনপ্রিয়।

উদাহরণ:

ইরাক: চিনা CH-4 ব্যবহার করছে আইএসআইএস দমনে।
জর্ডান: চিনা ড্রোন থেকে শুরু করে নিজেদের ড্রোনও তৈরি করছে।
সংযুক্ত আরব আমিরশাহী: চিনা ও ইজ়রায়েলি প্রযুক্তি একসঙ্গে ব্যবহার করছে।

ইউক্রেন যুদ্ধ: নতুন উদাহরণ

২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধ স্পষ্ট দেখিয়ে দিয়েছে Combat Drone ছোট দেশের প্রতিরক্ষার চেহারা কতটা বদলে দিতে পারে।
রাশিয়ার ট্যাঙ্ক-সজ্জিত বিশাল বাহিনীকে ইউক্রেন ছোট ছোট কমব্যাট ড্রোন ও কামিকাজ়ি ড্রোন দিয়ে আঘাত করেছে।

উদাহরণ:

  1. Switchblade Drone (US)
  2. Bayraktar TB2 (Turkey)
  3. Homemade Drones

এইসব কম খরচের ড্রোন দিয়ে ইউক্রেন রাশিয়ার বিলিয়ন ডলারের সামরিক যানবাহন ধ্বংস করছে।

দরিদ্রের আকাশ খালি, ধনীদের মাথায় বিমানের সারি, এক ক্লিকেই বিশ্বের আর্থিক অবস্থা

ড্রোন যুদ্ধের নতুন ধরণ: কামিকাজ়ি ড্রোন

  • একটি বড় পরিবর্তন এসেছে কামিকাজ়ি ড্রোন বা লোইটারিং মিউনিশন-এ।
  • এটি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার পর নিজেই ফেটে যায় — প্রায় সস্তা মিসাইলের মতো কাজ করে। ছোট দেশগুলো ব্যয়বহুল ক্ষেপণাস্ত্র না কিনে এভাবে Smart Attack চালাতে পারে।
  • এতে কম সময়ে একাধিক জায়গায় ছোট ছোট হামলা চালানো যায়।

উদাহরণ:

  1. Iran’s Shahed-136 Drone
  2. US Switchblade Drone

ইজ়রায়েল: কমব্যাট ড্রোনের পথপ্রদর্শক

ইজ়রায়েল বহু আগে থেকেই ছোট দেশের জন্য Drone Warfare-এ উদাহরণ তৈরি করেছে।
IAI Heron, Harop ইত্যাদি ড্রোন সারাবিশ্বে রপ্তানি করছে। ছোট দেশগুলো ইজ়রায়েলি প্রযুক্তি শিখে নিজেরাও Surveillance Drone ও কামিকাজ়ি ড্রোন তৈরি করছে।

কমব্য়াট ড্রোন

রয়েছে চ্যালেঞ্জও

তবে ছোট দেশগুলোর জন্য ড্রোন সব সমস্যার সমাধান নয়:

জ্যামিং: বড় দেশগুলো ইলেকট্রনিক জ্যামার দিয়ে ড্রোন নামিয়ে ফেলতে পারে।
এয়ার ডিফেন্স: অ্য়ান্টি-ড্রোন গান ও মিসাইল সিস্টেম ড্রোন আটকাতে পারে। ভারত যেমন S400 দিয়ে পাকিস্তানের ড্রোন ধ্বংস করেছি।

তাই নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করেন, ড্রোন প্রযুক্তি যত সহজ হচ্ছে, ততই নতুন যুদ্ধের ধরন আরও জটিল হয়ে যাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০৩০ সালের মধ্যে প্রায় ৫০টির বেশি ছোট দেশ Combat Drone Squadron তৈরি করবে।

ছোট দেশের জন্য এটি একদিকে নতুন সুযোগ, অন্যদিকে নতুন চ্যালেঞ্জও বটে।

বড় দেশগুলোর কাছে যেখানে একটি ফাইটার জেট বা ক্ষেপণাস্ত্র ডিফেন্স সিস্টেমে কোটি কোটি ডলার খরচ হয়, সেখানে ছোট দেশগুলো তুলনামূলক অল্প খরচে Combat Drone Technology ব্যবহার করে শক্তি বৃদ্ধি করছে।

যুদ্ধের ধরন বদলে যাচ্ছে। এখন আর শুধু ট্যাঙ্ক বা যুদ্ধবিমানের উপর নির্ভর নয় — ড্রোন যুদ্ধ (Drone Warfare) ছোট দেশগুলোকেও নতুন মাত্রার সামরিক শক্তি দিচ্ছে।

তথ্যসূত্র

BBC Defence: How drones are changing modern warfare
Al Jazeera: Ukraine’s drone tactics explained
Forbes Defence: Turkey’s Bayraktar TB2 success story
Defense News: Israeli drone exports to small countries
Reuters: Iran’s kamikaze drones



Discover more from Unknown Story

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Leave a Reply