৩০ বছরের লড়াই, ভিয়েতনাম যুদ্ধের রক্তাক্ত অধ্যায়

ভিয়েতনাম যুদ্ধ

বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম দীর্ঘ ও বিতর্কিত যুদ্ধ হল ভিয়েতনাম যুদ্ধ (Vietnam War)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই এশিয়ার এই দেশে শুরু হয় বিভক্তি ও সংঘাত। প্রায় ২০ বছর ধরে চলা এই যুদ্ধের প্রভাব শুধু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া নয়, গোটা বিশ্ব রাজনীতিকেই নাড়িয়ে দিয়েছিল।

ভিয়েতনাম যুদ্ধ নিয়ে লিখতে গেলে অনেকটা বড় হয়ে যাবে। তাও এই প্রতিবেদনে চেষ্টা করা হচ্ছে যতটা সম্ভব কভার করা যায়।

ভিয়েতনাম যুদ্ধের শুরু?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান ভিয়েতনাম দখল করে।

জাপানের পরাজয়ের পর ভিয়েতনামের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা হো চি মিন (Ho Chi Minh) ১৯৪৫ সালে গণপ্রজাতান্ত্রিক ভিয়েতনাম বা Democratic Republic of Vietnam ঘোষণা করেন।

কিন্তু ফরাসিরা উপনিবেশ পুনর্দখলের চেষ্টা করে। ফলে শুরু হয় প্রথম ইন্দোচিন যুদ্ধ যা ফরাসি চিন যুদ্ধ নামেও পরিচিত (First Indochina War)। এটা চলে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত।

ভিয়েতনাম ওয়ার

১৯৫৪ সাল: জেনেভা চুক্তি ও ভিয়েতনামের বিভক্তি

১৯৫৪ সালে ফরাসি বাহিনী ডিয়েন বিয়েন ফু (Dien Bien Phu war) যুদ্ধে পরাজিত হয়।

এরপর জেনেভা চুক্তি (Geneva Accords) অনুযায়ী ভিয়েতনামকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়:

উত্তর ভিয়েতনাম: হো চি মিনের কমিউনিস্ট সরকার
দক্ষিণ ভিয়েতনাম: পশ্চিমের দেশগুলো সমর্থিত সরকার (নন কমিউনিস্ট সরকার)

তবে শুরুতে ঠিক করা হয়েছিল, দেশকে এক করার জন্য নির্বাচন হবে। কিন্তু তা আর হয়নি।

ফলে উত্তরের কমিউনিস্টদের সঙ্গে দক্ষিণের বিরোধ শুরু হয়।

কেন হরমুজ় প্রণালী নিয়ন্ত্রণ করতে চায় ইরান? ভারতের কাছে গুরুত্ব কতটা?

১৯৫৫-১৯৬৩: ভিয়েতনাম ইস্যুতে আমেরিকার জড়িয়ে পড়া

দক্ষিণ ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট বিরোধী সরকারকে রক্ষার জন্য আমেরিকা আর্থিক ও সামরিক সহায়তা শুরু করে।

১৯৬১ সালে আমেরিকার ৩৬ তম প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি বিশেষ মিলিটারি অ্যাডভাইসরি গ্রুপ পাঠান উত্তর ভিয়েতনামে কিন্তু তা ব্যাকফায়ার করে।

১৯৬৩ সালে দক্ষিণ ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট দিয়েম গণ অভ্যুত্থানে নিহত হন, যা রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও বাড়ায়।

১৯৬৪: টঙ্কিন উপসাগর দুর্ঘটনা

ভিয়েতনাম যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি অংশগ্রহণের বড় মোড় হল টঙ্কিন উপসাগর দুর্ঘটনা (Gulf of Tonkin Incident)।

আমেরিকার যুদ্ধজাহাজে হামলার অভিযোগে টঙ্কিন রেজোলিউশন পাশ হয়, যার ফলে প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি. জনসন উত্তর ভিয়েতনামে বিমান হামলা চালানোর অনুমতি পান। এরপর থেকেই যুদ্ধ পূর্ণমাত্রায় ছড়িয়ে পড়ে।

দরিদ্রের আকাশ খালি, ধনীদের মাথায় বিমানের সারি, এক ক্লিকেই বিশ্বের আর্থিক অবস্থা

১৯৬৫-১৯৬৮: যুদ্ধের চরম পর্যায়

এই সময়ে আমেরিকা লাখ লাখ সৈন্য ভিয়েতনামে মোতায়েন করে। অপারেশন রোলিং থান্ডার (Operation Rolling Thunder) নামে ব্যাপক বোমা হামলা চালানো হয়।

আমেরিকার অনেক সৈন্যই ভিয়েতনাম নামে কোনও দেশের অস্তিত্বের ব্যাপারে জানতেন না সেখানে যাওয়ার আগে পর্যন্ত।

ভিয়েতনামের মানচিত্র

ভিয়েতনাম মানচিত্র

টেট আক্রমণ (১৯৬৮)

১৯৬৮ সালে ভিয়েতনামের টেট উৎসবের সময় উত্তর ভিয়েতনাম ও ভিয়েতকং গেরিলা বাহিনী একযোগে দক্ষিণের বড় শহরগুলোতে হামলা চালায়। যদিও তারা সামরিকভাবে পিছিয়ে পড়ে, এই হামলা আমেরিকান জনমতকে যুদ্ধবিরোধী করে তোলে।

১৯৬৯: আমেরিকার ‘ভিয়েতনামাইজ়েশন’ নীতি

১৯৬৯ সালে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ক্ষমতায় এসে ‘ভিয়েতনামাইজেশন’ নীতি চালু করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল ধীরে ধীরে আমেরিকান সৈন্যদের সরিয়ে স্থানীয় ভিয়েতনামী বাহিনীকে শক্তিশালী করা।

১৯৭৩: প্যারিস শান্তি চুক্তি

দীর্ঘ যুদ্ধের ফলে দেশে দেশে মার্কিন বিরোধিতা বাড়তে থাকে। শেষ পর্যন্ত ১৯৭৩ সালে প্যারিস শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ও আমেরিকা সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়।

কিন্তু উত্তরের কমিউনিস্টরা থেমে যায়নি।

১৯৭৫: সাইগন পতন

৩০ এপ্রিল ১৯৭৫ সালে উত্তরের বাহিনী তৎকালীন দক্ষিণ ভিয়েতনামের রাজধানী সাইগন দখল করে নেয়। এটি ভিয়েতনাম যুদ্ধের সমাপ্তি নির্দেশ করে।

এরপরই পুরো ভিয়েতনাম এক হয়ে সমাজতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক ভিয়েতনাম (Socialist Republic of Vietnam) হয়।

মারিয়ানা খাত: পৃথিবীর গভীরতম গোপন রহস্য

ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রভাব

ভিয়েতনাম যুদ্ধ প্রায় ২০ বছর স্থায়ী হয়েছিল। ৩০ লাখের বেশি ভিয়েতনামী নাগরিক নিহত হয়, আমেরিকার প্রায় ৫৮,০০০ সৈন্য প্রাণ হারায়।

এই ঠাণ্ডা যুদ্ধের সময়কালীন মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির বড় ব্যর্থতা হিসেবে বিবেচিত হয়।

ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর আমেরিকান সমাজে যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন, হিপ্পি কালচার এবং মানবাধিকার আন্দোলনও তীব্র হয়।

ভিয়েতনাম যুদ্ধ বিশ্বকে শেখায় — শুধু সামরিক শক্তি নয়, স্থানীয় সংস্কৃতি, মানুষের সমর্থন ও রাজনৈতিক কূটনীতি যুদ্ধ জয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

ভিয়েতনাম যুদ্ধের টাইমলাইন ১৯৪৫-১৯৭৫

১৯৪৫: হো চি মিন স্বাধীনতা ঘোষণা
১৯৫৪: ডিয়েন বিয়েন ফু যুদ্ধ ও জেনেভা চুক্তি
১৯৬৪: টঙ্কিন উপসাগর দুর্ঘটনা
১৯৬৫: মার্কিন সৈন্য মোতায়েন বৃদ্ধি
১৯৬৮: টেট হামলা
১৯৬৯: নিক্সনের ‘ভিয়েতনামাইজেশন’
১৯৭৩: প্যারিস শান্তি চুক্তি
১৯৭৫: সাইগন পতন

ভিয়েতনাম যুদ্ধের ইতিহাস এক দিক থেকে শোষণ-বিরোধী সংগ্রাম, অন্যদিকে ঠাণ্ডা যুদ্ধের ছায়াযুদ্ধ। আজও এই যুদ্ধের গল্প নতুন প্রজন্মের কাছে যুদ্ধের মূল্য ও শান্তির গুরুত্ব বোঝায়।

তথ্যসূত্র:

  • BBC History: Vietnam War Timeline
  • History Channel: Vietnam War Facts
  • Encyclopedia Britannica: Vietnam War
  • US National Archives: Gulf of Tonkin Resolution
  • CIA World Factbook: Vietnam Country Profile


Discover more from Unknown Story

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Leave a Reply